ট্রেস মিনারেল জিঙ্ক হল এমন এক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা শক্তিশালী রোগ-প্রতিরোধ, নার্ভাস এবং প্রজনন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করার মাধ্যমে ছোট বাচ্চাদের বৃদ্ধি ও বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেহ নিজে থেকে জিঙ্ক তৈরি করে না, তাই এটিকে আমাদের ডায়েটে বা জিঙ্ক সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। জিঙ্কের ঘাটতির কারণে শিশুদের খিদে কমে যায়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, চর্মরোগ হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং জ্ঞানীয় বুদ্ধি কম বিকশিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে যে, জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার বা জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ জনসংখ্যার মৃত্যুহার এবং অসুস্থতার হার কমাতে পারে এবং 6 মাস থেকে 12 বছর বয়সী শিশুদের উপর জিঙ্ক সাপ্লিমেন্টগুলির প্রতিরোধমূলক ক্রিয়া প্রদর্শন করে।
এখানে জিঙ্কের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত খাদ্যগত পরিমাণ (RDA) দেওয়া হল
RDA হল প্রতিদিনের গড় মাত্রা, যা একজন সুস্থ ব্যক্তির নিউট্রিয়েন্টের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। RDA বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।
2010 সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR) বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন নিউট্রিয়েন্টের জন্য RDA নির্ধারণ করেছে। 1-12 বছর বয়সী শিশুদের জন্য জিঙ্কের ক্ষেত্রে RDA নিম্নরূপ:
- 1 থেকে 3 বছর: প্রতিদিন 5 মিলিগ্রাম
- 4 থেকে 6 বছর: প্রতিদিন 7 মিলিগ্রাম
- 7 থেকে 9 বছর: দৈনিক 8 মিলিগ্রাম
- 10 থেকে 12 বছর: দৈনিক 9 মিলিগ্রাম
শরীর এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে জিঙ্কের ভূমিকা
জিঙ্ক শরীরের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। আমাদের দেহে জিঙ্কের বিভিন্ন কার্যাবলী নিচে শ্রেণীবদ্ধ করা হল:
- জৈবরাসায়নিক - জিঙ্ক এনজাইমগুলির জন্য একটি কো-ফ্যাক্টর এবং কোষ বিভাজন ও সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত উপাদানের সংশ্লেষণ এবং স্থিতিশীলতার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- কোষীয় - এটি কোষের বৃদ্ধি এবং বিকাশ, কোষীয় ঝিল্লির অখণ্ডতা বজায় রাখা, টিস্যু বৃদ্ধি ও মেরামত এবং ক্ষত নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ইমিউনোলজিকাল - নিউট্রোফিল, T-সেল, B-সেল এবং প্রাকৃতিক ঘাতক কোষের মতো ইমিউন কোষ উৎপাদনে সাহায্য করে।
- এন্ডোক্রিনোলজিকাল - থাইরয়েড হরমোন বিপাক, প্রজনন (শুক্রাণুজনিত), অগ্ন্যাশয়ের ফাংশন এবং প্রোল্যাক্টিন নিঃসরণে জিঙ্ক সাহায্য করে।
- স্নায়বিক - এটি শিশুদের জ্ঞান, স্মৃতি, রুচি, তীক্ষ্ণতা এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি ও উন্নত করে।
- হেমাটোলজিকাল - জিঙ্ক লোহিত রক্তকণিকা গঠন, হিমোগ্লোবিন এবং হেমাটোক্রিটকে উদ্দীপিত করে এবং রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
- স্কেলিটাল - এটি হাড়ের খনিজীকরণে সহায়তা করে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, যা বৃদ্ধি এবং বিকাশকে প্রভাবিত করে।
যে 5টি খাবারে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক উপস্থিত থাকে
- হোল গ্রেইন এবং শুঁটি জাতীয় শস্য - গম, কুইনোয়া, ওটস, চাল, ছোলা, কলাই এবং বিনসে যথেষ্ট পরিমাণে জিঙ্ক এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। অঙ্কুরিত করা, গাঁজন করা এবং ভিজিয়ে রাখা জিঙ্কের জৈব উপলভ্যতা ও শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। আপনি এই গ্রেইন এবং শুঁটি জাতীয় শস্য দিয়ে ডাল, খিচুড়ি এবং স্যুপ প্রস্তুত করতে পারেন।
- শাকসবজি এবং বীজ - পাম্পকিন সিড, হেম্প সিড, সিসাম সিড এবং স্কোয়াশে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। এছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ভিটামিন রয়েছে। বীজগুলিকে বেকড আইটেমগুলিতে ব্যবহার করা যেতে পারে, স্যালাড ও শেকে যোগ করা যেতে পারে বা তেলে ভাজা খাবারেও ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আলু, সবুজ মটরশুটি, মাশরুম, কেলের মতো সবজিতেও অল্প পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। আপনি এগুলি দিয়ে তরকারি এবং স্টু অথবা প্রস্তুত করতে পারেন।
- বাদাম - চিনাবাদাম, কাজু এবং আমন্ড জিঙ্ক এবং ম্যাগনেসিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস। এছাড়া এগুলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ফাইবারেরও ভালো উৎস। ভারতীয় খাদ্যগত পরিমাণ সারণী, 2017 অনুযায়ী, 100 গ্রাম কাজুতে 5.34 মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। আপনি এই বাদামগুলি ভাত, তরকারি, স্মুদি বা মিষ্টি খাবারে যোগ করতে পারেন বা শুধু শুধুও খেয়ে উপভোগ করতে পারেন।
- দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য - দুধ, ইয়োগার্ড, ফোর্টিফাইড চিজ নিরামিষাশীদের পক্ষে উপযোগী জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার। 2017 সালের ভারতীয় খাদ্যগত পরিমাণ সারণী অনুসারে এক গ্লাস (200 মিলি) গরুর দুধে 0.66 মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে এবং 100 গ্রাম পনিরে প্রায় 2.7 মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে। মিল্ক শেক, স্মুদি ও চিজ ডিপ হল জনপ্রিয় রেসিপি, যেগুলি আপনি চেষ্টা করতে পারেন। সিরিয়াল বা ওটসেও ইয়োগার্ট বা দুধ যোগ করা যেতে পারে।
- ডার্ক চকোলেট- এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও জিঙ্ক। প্রায় 100 গ্রাম ডার্ক চকোলেট বা 70-85% ডার্ক চকোলেটের বারে 3.3 মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে। মাফিন, কেক বা কুকিজের মধ্যে ডার্ক চকোলেট যোগ করলে ভাল হয়। আপনি এটির সাহায্যে সুস্বাদু শেক এবং আইসক্রিমও প্রস্তুত করতে পারেন।
নতুন গবেষণা অনুসারে শিশুদের মধ্যে জিঙ্কের আরও কিছু উপকারিতা এখানে জানানো হল
- ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো এবং জার্নাল “নিউরন” -এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, মস্তিষ্কের নিউরনগুলি কিভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে জিঙ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শিশুদের মধ্যে শেখার এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।
- ওপেন রেসপিরেটরি মেডিসিন জার্নাল এবং কোচরেন রিভিউয়ের একটি সমীক্ষা এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে জিঙ্ক লজেন্স বা সিরাপ গ্রহণ করা শিশুদের সাধারণ ঠান্ডা এবং উপরের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ কমাতে উপকারী।
- বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার চিকিৎসায় সাহায্য করে।
- জিঙ্ক ত্বকের অখণ্ডতা ও গঠন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ত্বকের আলসার, ব্রণ, ডায়াপার ফুসকুড়ি এবং জ্বালা নিরাময়ে সাহায্য করে।
- বয়স-সম্পর্কিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (AMD)-এর মতো সমস্যাও ডায়েটে জিঙ্ক অন্তর্ভুক্ত করার দ্বারা হ্রাস করা যেতে পারে যা রেটিনার সেলুলার ক্ষতি প্রতিরোধ করে, এবং এইভাবে AMD এবং দৃষ্টি ক্ষতির অগ্রগতি বিলম্বিত করতে সহায়তা করে।
তাই উপসংহারে বলতে চলে যে, জিঙ্ক হল একটি অপরিহার্য ট্রেস মিনারেল যা শিশুদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি বৃদ্ধি এবং বিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে, অনাক্রম্যতা উন্নত করে, জ্ঞানীয় বিকাশে সহায়তা করে এবং শিশুদের সাধারণ সর্দি ও ডায়রিয়া নিরাময় ঘটায়। হোল গ্রেইন খাবার, ফর্টিফায়েড সিরিয়াল, রান্না করা বিনস, চিজ, ওটমিল, কাজু এবং আমন্ড হল কিছু চমৎকার জিঙ্ক-সমৃদ্ধ খাবারের বিকল্প যা ছোট বাচ্চাদের খাদ্যতালিকায় যোগ করা উচিত যাতে তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করা যায়।
আপনার সন্তানের বৃদ্ধি এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও জানতে www.nangrow.in -এ যান