কৃমির আক্রমণে শিশুসহ সব বয়সী মানুষজনই আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, 14 বছরের কম বয়সী প্রায় 64% শিশুর কৃমি সংক্রমণের প্রচুর ঝুঁকি রয়েছে। কৃমি মাটি বা দূষিত জলের মাধ্যমে সংক্রামিত হতে পারে। শিশুদের সুস্বাস্থ্য ও সঠিক বিকাশের ক্ষেত্রে কৃমিনাশক খাওয়া জরুরি। তাই কৃমিনাশ করার কারণ, লক্ষণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন।
কৃমির প্রকারভেদ এবং কৃমি হওয়ার কারণ
সবচেয়ে সাধারণ কৃমি হল গোলকৃমি বা রাউন্ডওয়ার্ম, হুইপওয়ার্ম এবং হুকওয়ার্ম। কৃমি সাধারণত মাটিতে ডিম পাড়ে এবং ডিমে আক্রান্ত শাক-সবজির মাধ্যমে এসব ডিম শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে, যেগুলি পরিষ্কার করা হয় না, খোসা ছাড়ানো থাকে না বা ঠিকমতো রান্না করা হয় না। এগুলো দূষিত জলের উৎস থেকেও দেহে প্রবেশ করতে পারে। শিশুরা কাদায় খেলা করার সময় তাদের মুখের মধ্যে হাত ঢোকালেও কৃমি তাদের দেহে প্রবেশ করতে পারে।
যেসব সংক্রমিত ব্যক্তি খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেন, তারাও মলের মাধ্যমে এই কৃমির ডিম ছড়িয়ে থাকেন। অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের পাশাপাশি বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানীয় জলের অভাব কৃমিতে সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। উপরের যে কোনও একটি মাধ্যমে একবার এই ডিমগুলি আপনার সন্তানের পেটে প্রবেশ করলে তা শিশুর অন্ত্রের মধ্যে আটকে গিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিতে পরিণত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে ডিম পাড়ে। কৃমির ডিম অতিক্ষুদ্র প্রকৃতির এবং খালি চোখে সহজে দেখা যায় না। এগুলি দীর্ঘ সময় অন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং লক্ষণগুলি গুরুতর হয়ে গেলে তবেই কেবল শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য অনেক জায়গায় একযোগে অনেকের কৃমিনাশক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
কৃমিতে সংক্রমণের লক্ষণ
কৃমিতে সংক্রমণের তীব্রতার উপর উপসর্গগুলি নির্ভর করে:
- স্বল্প সংক্রমণে আক্রান্ত (কম সংখ্যক কৃমি) শিশুদের মধ্যে সাধারণত খুব বেশি উপসর্গ দেখা যায় না।
- কৃমির পরিমাণ বেড়ে গেলে সংক্রমণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং এর ফলে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যথা ও দুর্বলতাসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
- আপনার সন্তান পায়ুপথের চারপাশে চুলকানি অনুভব করতে পারে এবং সে ক্রমাগত সেই জায়গাটা আঁচড়ে যেতে থাকে। লাগাতার চুলকানি ও আঁচড়ানির ফলে এই স্থানে ফুসকুড়ি ও ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে।
- এই কৃমিগুলি মেয়েদের যোনি অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে যোনির চারপাশে তীব্র চুলকানি হয়।
- আরেকটি লক্ষণ যা আপনার লক্ষ্য করা উচিত, সেটি হল খিদের অভাব।
পুষ্টির উপর প্রভাব
কৃমির আক্রমণ আপনার সন্তানের পুষ্টির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কৃমি রক্ত সহ আপনার সন্তানের টিস্যুগুলি শুষে নেওয়া এবং এই টিস্যুগুলি থেকে তাদের নিজস্ব পুষ্টি গ্রহণ করার প্রবণতা রাখে। ফলস্বরূপ, আপনার সন্তানের শরীর থেকে আয়রন এবং প্রোটিনের সুস্পষ্ট ক্ষতি হয় এবং এটির কারণে আপনার সন্তানের রক্তাল্পতা হতে পারে। আপনার শিশু যে পুষ্টি গ্রহণ করে, কৃমি তা শোষণ করে এবং ফলস্বরূপ, সেগুলি তার শরীরের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য আর উপলব্ধ থাকে না। পুষ্টির অভাবে শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে এবং এটি আপনার সন্তানের সামগ্রিক মানসিক বিকাশ ও শিক্ষার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আপনার সন্তান খিদে না পাওয়ার সমস্যায় ভুগতে পারে এবং তার খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে আপনার সন্তানের শারীরিক গঠনেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কয়েক ধরনের কৃমির কারণে ডায়রিয়া ও আমাশয় হতে পারে। এর ফলে জল, তরল এবং বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইটের অভাব হতে পারে, যা আপনার সন্তানের পুষ্টির ঘাটতি তৈরি করতে পারে। এছাড়াও এর ফলে অপুষ্টি এবং সংক্রমণের খারাপ প্রভাব ঘটতে পারে, কারণ আপনার সন্তান যখন অপুষ্টিতে ভোগে, তখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সে অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।
প্রতিরোধ
নিম্নলিখিত অভ্যাসগুলি অবলম্বন করে কৃমিতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যেতে পারে:
- সর্বদা পরিষ্কার, পানযোগ্য এবং নিরাপদ পানীয় জল খাওয়ান। এটা কেবল আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
- রান্নার আগে সমস্ত সবজি, ফল ও মাংস যেন ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় এবং ভালো করে ধুয়ে ফেলা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- সব ধরনের খাবার যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে রান্না করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব সময় খাদ্যসামগ্রী ঢেকে এবং নিরাপদ রাখতে হবে।
- নিশ্চিত করুন যে আপনার সন্তান ঘরে থাকার সময় এবং বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহার করার সময় সঠিক জুতো ব্যবহার করে। আপনার সন্তান যেন মাটিতে খেলার সময় উপযুক্ত জুতো পরে।
- বিশেষ করে খাওয়ার আগে এবং পরে এবং সেইসাথে টয়লেট ব্যবহারের পরে আপনার সন্তান যেন সাবান ও জল ব্যবহার করে এবং তার হাত ভালভাবে ধোয় তা নিশ্চিত করুন। প্রায়শই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করাও সহায়ক হতে পারে।
- বাড়িতে ও আশেপাশে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
কী ভাবে কৃমির চিকিৎসা করা হয়?
কৃমি সংক্রমণের চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে ডিওয়ার্মিং বা কৃমিনাশকারী পদ্ধতি বলা হয়। যেসব ওষুধ নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে, সেসব ওষুধের সাহায্যে শিশুদের কৃমিমুক্ত করা হয়। আপনার ডাক্তার ওষুধ এবং কৃমিনাশের সময়সূচীর ব্যাপারে আপনাকে গাইড করতে পারেন। ট্যাবলেটটি 2 চামচের মধ্যে ভেঙে গুঁড়ো করে জল দিয়ে খেতে হবে। বড় শিশুদের ট্যাবলেট চিবিয়ে খাওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে তার পর একটু জল খাওয়া উচিত।
কৃমিনাশের উপকারিতা
শিশুদের কৃমিনাশ করা বিভিন্ন উপায়ে উপকারী:
- কৃমিমুক্ত শিশুরা পুষ্টির অবস্থা উন্নত করতে পারে এবং তাদের শারীরিক বিকাশকে উদ্দীপ্ত করতে পারে।
- এটি আপনার সন্তানকে উপযুক্ত ওজন বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
- কৃমিনাশের পরে উন্নত পুষ্টি জ্ঞানীয় এবং মানসিক ক্ষমতার বিকাশে সাহায্য করতে পারে।
- কৃমিনাশ অ্যানিমিয়া নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
- এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে
.
কৃমির আক্রমণ আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি আপনি চিন্তা করেন যে আপনার সন্তানের খিদে কমে গেছে বা তার সংক্রমণ ঘটতে পারে, তাহলে কৃমিনাশক ওষুধ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
জাতীয় কৃমিনাশক দিবস
ভারত সরকারের নিয়মানুযায়ী, ভারতের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে বছরে দু'বার যথাক্রমে 10 ফেব্রুয়ারি এবং 10 আগস্ট জাতীয় কৃমিনাশক দিবস পালন করা হয়। মানবসম্পদ ও উন্নয়ন মন্ত্রক, মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক এবং পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রকের অধীনে স্কুল শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিভাগের একটি যৌথ উদ্যোগ হল এই গণ কৃমিনাশক কর্মসূচি। এই প্রোগ্রামের প্রধান সুবিধাভোগী হল 1-19 বছর বয়সী শিশুরা (বালক-বালিকা উভয়ই)।