রীল স্ক্রল করতে করতে সকালের জলখাবার কোনওরকমে গিলে খাওয়া, বা যেখানে একটি মাঝারি মাপের বার্গারেই পেট ভড়ে যায় সেখানে লোভের বশে লার্জ সাইজের বার্গারের অর্ডার করা? সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন যেগুলি আপনার এই অনিচ্ছাকৃত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসগুলির বিষয়ে আরও জানতে এবং কীভাবে সেগুলি কাটাবেন তা জানতে পড়ুন।
বেঁচে থাকার জন্য খাও, এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য একটি মন্ত্রের মত ছিল, যাঁরা খাদ্যকে একটি প্রয়োজনীয়তা বলে মনে করতেন, বিলাসিতা নয়। তবে, কালে কালে জল যত গড়িয়েছে, খাদ্যাভ্যাসের সংজ্ঞাও বদলে গেছে। প্রযুক্তিতে আমূল পরিবর্তন এবং মাত্র সামান্য কয়েকটি অঙ্গুলি হেলনেই অতি সহজেই আজ সুস্বাদু খাওয়ার চলে আসে একেবারে দোড় গোড়ায়, আর ফলস্বরূপ বর্তমানে মানুষ যেন খাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকে। লোভ সামলানো দুস্কর এমন সব খাবারের রন্ধন প্রনালী, চোখ টাটানো প্ল্যাটার, প্রবল আবেগ এবং অত্যধিক কাজের চাপ - অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠায় এই সবেরই অবদান আছে। একবিংশ শতাব্দীতে অসংক্রামক ও জীবনযাত্রার কারণে হওয়া রোগের বৃদ্ধির মূলও রয়েছে স্বাস্থ্যকর এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের ভারসাম্যহীনতা, যেখানে পরবর্তীটির ওজন অনেক বেশি। তবে জীবনযাত্রার কিছু সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনি অতি সহজেই সুচিন্তিত খাদ্যাভ্যাসের দিকে ঝুঁকতে পারেন, ভালো ও খারাপ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য জানতে পারেন এবং খারাপ খাদ্যের প্রতি আগ্রহ যে বিপদ ডেকে আনে তা এড়িয়ে চলতে পারেন।
জীবনযাত্রায় খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব
আন্ডার-ইটিং ও ওভার-ইটিং এর মত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসগুলি আমাদের লাইফস্টাইলে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। যেহেতু খাদ্য স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা এনে দেয়, এটি শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহ জীবনের সমস্ত মানদণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কিছু প্রভাবের বিষয়ে বলা হল:
- আমাদের সার্বিক সুস্থতা নষ্ট করে, শরীরকে আরও সংক্রমণশীল করে তোলে
- মানসিক চাপ ও ক্লান্তির মাত্রা বাড়াতে পারে
- এর কারণে ত্বকের ক্ষতিসাধন হতে পারে এবং চুল পড়ে যেতে পারে
- রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস প্রাপ্তি এবং শরীরে প্রদাহের হার বৃদ্ধি
- মানসিক বিষণ্নতা এবং আলজাইমারের রোগের মতো মানসিক ব্যাধিগুলিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে
- খারাপ খাদ্যাভ্যাসের ফলে স্থূলতা, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি, হার্ট সংক্রান্ত ব্যাধী এবং ক্যান্সারের মতো রোগ দেখা দিতে পারে
10টি অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
নিচে 10টি খারাপ খাদ্যাভ্যাসের তালিকা দেওয়া হল:
- ব্রেকফাস্ট না করা: দিনের প্রথম খাবার হিসেবে সকালের নাস্তার সঙ্গে খাদ্যের গুণগত মান, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল জড়িত থাকে। সকালের জলখাবার জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপগুলির সাথে বিশেষ ভাবে যুক্ত এবং স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত জীবনের মান, মানসিক চাপ এবং বিষণ্নতাকেও এটি প্রভাবিত করতে পারে। যদি সকালের তাড়াহুড়ো বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছানোর জন্য আপনাকে সকালের জলখাবার না করায় বাধ্য করে, তবে আপনাকে অবশ্যই এই অভ্যাসটি সংশোধন করার কথা ভাবতে হবে কারণ সুস্বাস্থ্যের জন্য সকালের জলখাবারের বেশ কয়েকটি উপকারিতা রয়েছে।
- খাওয়ার সময় স্মার্টফোন স্ক্রল করা:আপনি কি জানেন, সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, খাওয়ার সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করা আপনার অতিরিক্ত খাওয়ার কারণ হতে পারে? খাবারের সময় কিছু হরমোন নিঃসৃত হয় যা আপনার তৃপ্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, এইভাবে আমরা কত পরিমাণ খাবার গ্রহণ করি সেটিও নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলি খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার তাগিদকে প্রতিরোধ করে। তবে, ফোন চালানোর কারণে মনোযোগ নষ্ট হওয়ায় এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে এবং এআপনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া, চেতনা হল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা খাদ্য গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফোন মাধ্যমে স্ক্রল করার মতো ক্রিয়াগুলো প্রকৃত কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে! তাই ফোন রেখে খাবারের প্রতি মনোযোগ অটুট রাখুন।
- প্লেটে খাদ্য বৈচিত্র্যের অভাব:অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের উদাহরণগুলির মধ্যে খাদ্যে বৈচিত্র্যের অভাব বা সাদামাঠা প্লেটও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই ধরনের খাবার যেমন, শুধু ভাত বা চিপসের মতো খাবার বেশিমাত্রায় খেলে খাওয়ার থালাহয়ে ওঠে বৈচিত্রহীন। আর এটিও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে একটি। আপনাকে অবশ্যই আপনার খাদ্যতালিকায় অধিকাংশ খাদ্যগোষ্ঠীর খাবারকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, যেগুলোর মধ্যে থাকবে সম্পূর্ণ শস্য ও ডাল, শাকসবজি, ফলমূল ও দুধ এবং দুধ থেকে তৈরি খাবার থেকে শুরু করে বাদাম ও ডিম!
- খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না: একটি আদর্শ পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কোনও খাদ্য আপনার ক্ষতি করতে পারে না যদি আপনি এটি সঠিক পরিমাণে এবং ফ্রিকোয়েন্সিতে গ্রহণ করেন। অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের মতো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসগুলির কারণ হল শৃঙ্খলাপরায়ণ থাকতে পারা এবং একটি পরিমিত আহারের পরিবর্তে অধিক আহার অর্ডার দেওয়ার তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। অতিরিক্ত পরিমাণ আহার আপনার দ্বারা গৃহীত ক্যালোরির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, এরফলে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা এবং এর সাথে আসা অসংখ্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর সাথে মোকাবিলা করার একটি আদর্শ পদক্ষেপ হল সর্বদা পরিমিত আহার করা। প্লেটের জায়গা দিয়ে খাবার পরিমাণের বিচার করবেন না, এভাবেই আপনি কম পরিমাণ খাবার খেতে পারবেন।
- আবেগের বশে খাওয়া: আবেগপূর্ণ খাওয়া নেতিবাচক আবেগ কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা আবেগের বশে অধিক পরিমাণে খেয়ে থাকি। তবে, শরীরচর্চা, বিবেচকরের মত খাদ্য গ্রহণ, আবেগে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং ইতিবাচক শরীরি ভাবমূর্তি বজায় রাখলে আবেগপ্রবণ খাদ্যাভ্যাস কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়া, একঘেয়েমির বোধ আপনার বর্তমান পরিস্থিতি ও জীবনের অর্থ খুঁজে না পাওয়ার কারণ হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য একঘেয়েমি খাওয়ার তাগিদ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে অতিরিক্ত ক্যালোরি গৃহীত হয় এবং স্থূলতা দেখা দিতে পারে। গবেষণা থেকে এমনটা পরামর্শ দেওয়া হয় যে পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপের পাশাপাশি সুষম খাদ্যাভ্যাস, মেজাজের পরিবর্তন এবং বিষণ্নতার ঝুঁকি কমাতে পারে। ফলে, সুষম খাদ্য আমাদের কৈশোরের এবং বয়ঃপ্রাপ্তির দিনগুলিতে অপরিহার্য।
- গোগ্রাসে খাওয়া: খাওয়ার ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলিকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হলো ধীরগতিতে খাবার খাওয়া এবং গিলে ফেলার আগে খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া। চিবিয়ে খাওয়ার কারণে পরিপূর্ণতার অনুভূতি বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি লালসাকেও হ্রাস করে। এর ফলে তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার প্রবণোতাও বন্ধ হয়। তাই এরপর যখন আপনি আপনার মুখের মধ্যে কিছু খাবার নেবেন, তা চিবানোর জন্য অতিরিক্ত এক মিনিট সময় রাখুন, কারণ চিবানোর ক্রিয়াটি খাওয়ার ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
- সুষম ডায়েটের পরিকল্পনা না করা:যদি আপনি একটি নির্দিষ্ট ভোজনের ক্ষেত্রে কী খেতে চান তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তৈরি না করেন, তাহলে আপনি ইচ্ছামত যেকোনও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিকল্প বেছে নিতে পারেন। এছাড়াও, পরিকল্পনার অভাব আপনাকে বেশি ক্যালরি যুক্ত করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গবেষণায়, এটি লক্ষ্য করা যায় যে যারা খাওয়ার সময় একটি লোভনীয় খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা বিচক্ষণতার সাথে তাদের খাদ্য পছন্দ করেছিল এবং কম ক্যালোরি যুক্ত অন্যান্য খাবার বেছে নেয় এবং এভাবে তারা তাদের মোট ক্যালোরি পরিমাণে ভাড়সাম্য রক্ষা করে।
- খাবার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা:আপনি কোন খাদ্যগুলি এড়িয়ে যাচ্ছেন তার উপরও নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্যকর ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠার বিষয়টি। যদিও এবিষয়ে ভিন্ন মত আছে, তবে সাধারণত ডায়েটিং এর ফলে আপনি যে খাবারগুলি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন সেগুলির প্এরতি আপনাকে বেশি আকাঙ্ক্ষিত করে তুলতে পারে যার ফলে আপনি অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের স্বীকার হতে পারেন। দিনের শেষার্ধে অতিরিক্ত ক্যালোরি নেওয়া: এমনটা পরামর্শ দেওয়া হয় যে, রাতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণের তুলনায় দিনের শুরুতে বেশী ক্যালোরি গ্রহণ করা অধিক উপকারী হতে পারে।
- পর্যাপ্ত ঘুম হয় না: ঘুমের অভাব একরাশ অস্বাস্থ্যকর আচরণের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, এবং উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবারের আগ্রহ বাড়িয়ে করে ওজন বৃদ্ধি করতে পারে। খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার
সুস্বাস্থ্যের জন্য ডায়েটই হল উত্তম জীবনধারণের রহস্য। তবে, বর্তমানের সুচর্চিত খাদ্য প্রবণতা এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার উপায়গুলি সম্পর্কে আপডেট থাকার উপর মনোনিবেশ করলেও, তার পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর আচরণগুলি চিহ্নিত করাও আমাদের জন্য সমানভাবে প্রয়োজনীয়। খারাপ খাবারের অভ্যাসগুলি জীবনের সামগ্রিক মানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে তাই স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাসগুলির জন্য আরও বেশি করে প্রচার করা আবশ্যক!