কম ওজন কেবলমাত্র কিশোরদের সঠিক বৃদ্ধিকেই বাধা দেয় এমনটা নয়, তাদের আবেগগত এবং মানসিক সমস্যাগুলিকেও আমন্ত্রণ জানায়। ওজন বৃদ্ধির জন্য জীবনযাপনে যে পরিবর্তনগুলো করতে হবে এবং যে খাবারগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে, সেগুলো সম্বন্ধে জানতে পড়তে থাকুন।

যদিও কিছু কিশোর-কিশোরী ওজন কমানোর সমস্যায় ভোগে, তবে অন্যদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিছু ব্যাক্তির জন্য, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে তারা কতটুকু খায়; তারা যতই খাক তাদের শরীর কোন পরিবর্তন দেখায় না এবং তারা অস্তি-চর্ম সার হয়েই থেকে যায়। যদিও ওজন বৃদ্ধি করা একটি কঠিন কাজ হতে পারে, কিন্তু ফাঁপা ক্যালোরিযুক্ত জাঙ্ক ফুডের উপর আস্থা রাখা কখনই কোনও ভাল উপায় নয়। এগুলি কেবলমাত্র আপনার শরীরের চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, আপনার পেশী গঠনে এগুলি কোনও কাজ করে না। তাই, কিশোর-কিশোরীদের ওজন বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে সঠিকভাবে সহায়তা প্রদাণ করার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যদ্রব্যসহ সঠিক পরিপূর্ণ আহারের প্রয়োজন।

টিনএজারদের জন্য আদর্শ ওজন কী?

একজন টিনএজারের আদর্শ ওজন নির্ভর করে তার উচ্চতার ওপর। আর এটি নির্ধারণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো BMI বা বডি মাস ইনডেক্স বিবেচনা করা।

মেয়েদের ক্ষেত্রে

বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালে তাদের হাড়ের গঠন, ওজন, উচ্চতা এবং শরীরের চর্বি বিতরণে অনানান রকম পরিবর্তন অনুভব করে।

ছেলেদের ক্ষেত্রে

অনেক ছেলে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর হঠাত বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এই সময় তারা হয় মোটা হয়ে যায়, না হয় চর্মসাড় হয়ে যায়। তাই কিশোর-কিশোরীদের ওজন বাড়ানোর জন্য বাস্তবসম্মত খাদ্যতালিকা বেছে নেওয়া প্রয়োজন।

টিনএজারদের ওজন বাড়ানোর টিপস

আদর্শ ওজনে পৌঁছানো এবং শরীরের চর্বি জমানো হল দুটি আলাদা বিষয়। শরীরের মেদ জমলেও ওজন বাড়ে, কিন্তু এতে পেশীর বিকাশ হয় না। তাই আদর্শ ওজন নির্ধারণের পাশাপাশি সেটি অর্জনের সঠিক উপায়ের দিকেও নজর দিতে হবে। টিনএজারদের ওজন বৃদ্ধির খাদ্য পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যকর খাবার থাকা উচিত যা তাদের পেটে অস্বাস্থ্যকর চর্বি জমতে না দিয়ে পেশী এবং শরীরের ভর গঠনে সাহায্য করতে পারে। টিনএজারদের ওজন বাড়ানোর কিছু টিপস এখানে দেওয়া হল।

  1. খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত-ক্যালরি দায়ক শস্য ভিত্তিক খাদ্য রাখুন
    কিশোর-কিশোরীদের অবশ্যই ওজন বাড়ানোর জন্য ব্যয়ের চেয়ে বেশি ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে। তাদের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই সবজি, খাদ্যশস্য, ফল, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট রাখতে হবে।
  2. মাংসপেশি গড়ে তুলতে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্যে বিশ্বাস রাখুন
    উপযুক্ত ব্যায়ামের পাশাপাশি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার কিশোর-কিশোরীদের শরীরে চর্বি জমতে না দিয়ে মাংসপেশি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। তাই, ওজন বৃদ্ধির পরও নিজের শারীরিক গঠন উন্নত করার জন্য কিশোর-কিশোরীদের ডায়েটে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার রাখতে উত্সাহিত করুন।
  3. ভোজনের পরিমাণ বাড়ান
    ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য, কিশোর-কিশোরীরা ধীরে ধীরে তাদের ভোজনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। রাতারাতি হয়তো সম্ভব হবে না, তবেএই অভ্যাসটি অনুসরণ করলে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে তাদের ওজন বৃদ্ধি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, সকালের জলখাবারে যদি তাদের দু'টো টোস্ট থাকে, তাহলে প্রথমে তিনটে তারপর চারটে করে বানিয়ে নিন।
  4. ব্রেকফাস্ট কখনই বাদ দেবেন না
    টিনএজারদের কোনওভাবেই ব্রেকফাস্ট বাদ দেওয়া চলবে না, বিশেষ করে যদি তারা কোনও টিনএজার ওজন বৃদ্ধির ডায়েট অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়। প্রাতরাশ শরীরকে রিচার্জ করে এবং দিনের শুরুটা করে প্রাণবন্তভাবে। তাদের দিন শুরু করা উচিত পুষ্টিকর ও উচ্চ শক্তির খাবার দিয়ে, যা ক্যালোরিতে পরিপূর্ণ। ব্রেকফাস্ট বাদ দিলে শরীরের মেটাবলিজমের ওপরও প্রভাব পড়ে এবং ওজনও কমে যায়।
  5. বেশি করে খান
    দিনে তিন বার খাওয়া ছাড়াও, কিশোর-কিশোরীরা খাবারের মধ্যে দুটি ক্যালরি-সমৃদ্ধ স্ন্যাক্স রাখতে পারে। এ ছাড়া, তারা ঘুমানোর আগেও একটি স্ন্যাক অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। তবে এর মানে এটা নয় যে, স্ন্যাকসেই তারা ডুবে থাকবে, তাদের মূলত প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার খেতে হবে। স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হল সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
  6. শরীরচর্চা
    উপযুক্ত ব্যায়াম যেমন, স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এবং সুষম ডায়েট প্ল্যান কিশোরদের তাদের শরীরের পেশী এবং ভর বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। সঠিক ব্যায়াম যেমন- স্কোয়াট, পুশ-আপ, পুল-আপ, ক্রাঞ্চ, লাঙ্গস, বর্পি ইত্যাদি শরীরের মূল জায়গাগুলোতে লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করবে এবং তাদের আরও ক্ষুধার্ত করে তুলবে, যার ফলে তারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খেতে পারবে।

ওজন বাড়ানোর জন্য যেসব খাবার আপনার ডায়েটে রাখতে হবে

ওজন ্বৃদ্ধিকারী খাদ্যদ্রব্য অবশ্যই লোভনীয় এবং স্বাস্থ্যকর হতে হবে যাতে তা সহজেই কিশোর-কিশোরীদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় যাতে তারা বিনা দ্বন্দে ওজন বৃদ্ধি করতে পারে। তার মধ্যে কয়েকটির নীচে উল্লেখ করা হল:

  1. দানাশস্য ও অন্যান্য খাদ্যশস্য
    সাধারণত খাদ্য হিসেবে গৃহীত শস্যগুলি হল গম, চাল, ভুট্টা, যব, ওটস, রাই, বাজরা এবং জোয়ার ইত্যাদি। প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এবং উচ্চ ক্যালরিযুক্ত হওয়ায় এগুলিকে প্রায়ই একটি পুষ্টিকর এবং সুষম ডায়েট প্ল্যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ওটমিল জটিল কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ডায়েটারি ফাইবারের উত্স, এটি একটি পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প হতে পারে করে। এগুলি কিশোর-কিশোরীদের দীর্ঘ সময় ধরে তৃপ্ত রাখতে পারে এবং জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে রাখতে পারে।
  2. বিন ও মুসুর ডাল
    বিন ও মুসুর ডালের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি, প্রোটিন ও ডায়েটারি ফাইবার। টিনএজাররা তাদের ডায়েটে তাদের বডি মাস পেতে এবং পেশীর বৃদ্ধিকে সমর্থন করতে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
  3. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
    দুধে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন থাকে যা কিশোর-কিশোরীদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া হাড় মজবুত করতেও এগুলো ভূমিকা রাখে। দিনে এক গ্লাস দুধ ক্যালরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি পুষ্টিকর উপায়। দুধের মতোই বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন পনিরও স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। এর উচ্চ পুষ্টিগুণের কারণে পনিরকে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের জন্য আদর্শ খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন D ও A এবং ফসফরাস ও ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান রয়েছে। পনির কিশোর-কিশোরীদের ওজন ও পেশি বাড়াতে সাহায্য করার পাশাপাশি তাদের পুষ্টির চাহিদার দিকেও নজর দেয়। টফু এবং সয়া পনির হল পনিরের অপর একটি নিরামিষ সংস্করণ। স্বাস্থ্যকর ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কিশোর-কিশোরীরা তাদের খাবারে দইও রাখতে পারে। যেমন শুধু ফল না খেয়ে তারা সহজেই দই স্মুদি তৈরি করে তাতে ফল যোগ করতে পারেন। দই খাবারে একটি স্বাস্থ্যকর সংযোজন, বেশ কয়েকটি খনিজ এবং প্রোবায়োটিক থাকার সুবাদে এটি সঠিক পরিপাক এবং পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে।
  4. আমিষ খাদ্য
    ডিম ও মুরগির মতো আমিষ খাবার কিশোর-কিশোরীদের সঠিক পরিমাণে ওজন বাড়াতে এবং তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডিম প্রোটিনে ভরপুর এবং পুষ্টিকর একটি খাদ্য। এগুলো টিনএজারদের শরীরে গ্রোথ মাসল তৈরিতে সহায়তা করে। এটি অল্প পরিমাণে খাদ্যে যোগ করলে তা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি প্রদাণ করে। বিশেষত গ্রিল বা সেদ্ধ করা মুরগি, কিশোর-কিশোরীদের প্রচুর প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে এবং তাদের খাদ্যে অতিরিক্ত-ক্যালরি বজায় রাখতে সাহায্য করে। মুরগিতে আছে সেলেনিয়াম ও জিঙ্কের মতো বেশ কিছু প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ, যা গোটা শরীরকে উপকৃত করে।
  5. স্টার্চযুক্ত সবজি
    স্টার্চযুক্ত সবজি যেমন, আলু এবং মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, জটিল কার্ব এবং বেশ কয়েকটি খনিজ থাকে। মিষ্টি আলুতেও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। টিনএজাররা স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে সরে না এসে সহজেই এগুলো থেকে তৈরি করতে পারেন সুস্বাদু স্ন্যাক্স। সুস্বাদু মিষ্টি আলুর পদ তৈরিতে এই রেসিপিটি ব্যবহার করতে পারেন ।
  6. ফল
    কলা প্রাণবন্ত ভিটামিন ও খনিজের একটি ভাণ্ডার। অন্যদিকে আমের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, পেক্টিন ও ভিটামিন C, ফলে এটি থেকে সহজেই মিল্কশেক, স্মুদি ও আইসক্রিম তৈরি করা যায়। একইভাবে, নারকেলের শঁশের দারুণ পুষ্টি ও ক্যালরি গুণ রয়েছে এবং এটি হার্ট-হেলদি ফ্যাটের ভাণ্ডার যা ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এখানে ফলের সম্পূর্ণ সমাহারের মধ্যে কেবল গুটি কয়েকই উল্লেখিত হল যা এদেরকে কিশোর বয়সে ওজন বৃদ্ধির খাদ্য পরিকল্পনার জন্য আদর্শ করে তোলে।
  7. শুকনো ফল, বাদাম এবং বীজ
    শুকনো ফল, বাদাম এবং বীজে রয়েছে উচ্চ পুষ্টি গুণ। একাধিক খনিজ ছাড়াও এতে রয়েছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা কিশোর-কিশোরীদের ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। টিনএজাররা এগুলিকে স্মুদি আর আইসক্রিমের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন অথবা এমনি এমনিই খেতে পারেন।

উপসংহার

স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির জন্য চাই ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং শৃঙ্খলা। কিশোর-কিশোরীদের উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অবলম্বন করতে হবে যাতে তাদের ওজন বৃদ্ধি পায় এবং তারা মোটা বা স্থূল না হয়ে পরে।

সঠিক খাদ্যদ্রব্য এবং রেসিপি বাছাই করলে সেটি কিশোর-কিশোরীদের ওজন নির্ধারণ এবং তাদের জীবনকে গঠন করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। এইরকম কিছু রেসিপি হল ধনেপাতার চাটনির সঙ্গে পনির আলুর পরোটা, চিকেন এবং পোড়ানো রসুন দিয়ে ফ্রায়েড রাইস,এবংদহি মেথি মুর্গ। সুতরাং, দ্রুত ফলাফলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় এমন টোটকাগুলির ফাঁদে পা না দিয়ে, তাদের অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী ফলাফলের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের রুটিন মেনে চলতে হবে।