আপনার সন্তানকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ানো চ্যালেঞ্জিং কাজ হতে পারে। আর তাদের অ্যালার্জি থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে,যেহেতু আপনার সন্তানের দেহে কয়েকটি প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কয়েকটি নির্দিষ্ট ফুড প্রোডাক্টে আপনার সন্তানের অ্যালার্জি থাকা নিয়ে কি আপনি চিন্তিত? খাবারে অ্যালার্জি এবং কীভাবে খাবারের বিকল্প বেছে নিতে পারেন, সে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানতে এই লেখাটি পড়ুন! এই বিকল্পগুলি কোনও ঝুঁকি সৃষ্টি না করেই আপনার ছোট্ট সন্তানের পুষ্টির চাহিদা পূরণে সাহায্য করতে পারে।
শিশুদের ফুড অ্যালার্জির ব্যাপারে ধারণা
শিশুরা তাদের সারাজীবনে বেশ কিছু অ্যালার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী বস্তুর সংস্পর্শে আসে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে বা খাওয়া খাবার থেকে অ্যালার্জেনগুলি তাদের দেহে প্রবেশ করে। অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া তখনই ঘটে যখন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যালার্জেনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই প্রতিক্রিয়ার ফলে হিস্টামাইন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা অ্যালার্জিজনিত লক্ষণগুলিকে সক্রিয় করে তোলে, যা বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে। 5 বছরের কম বয়সী প্রায় 5% শিশুর ফুড অ্যালার্জি রয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকজনের আজীবন থাকতে পারে।
ফুড অ্যালার্জি এবং ফুড ইনটলারেন্সের মধ্যে পার্থক্য
উপসর্গের দিক থেকে কিছু মিল থাকলেও ফুড অ্যালার্জি আর ফুড ইনটলারেন্স কিন্তু এক বিষয় নয়। ফুড ইনটলারেন্স হল শিশুদের তরফে ল্যাকটোজের মতো কয়েকটি খাবার হজম না হওয়া, যার ফলে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণ দেখা দেয়। অন্যদিকে, ফুড এলার্জি হল অ্যালার্জেনের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া।
ফুড অ্যালার্জির লক্ষণ
খাবার খাওয়ার পরে উপসর্গগুলি অবিলম্বে বা এক ঘন্টার মধ্যে দেখা দেওয়া শুরু হতে পারে এবং নিম্নলিখিতগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- আমবাত
- একজিমা
- কাশি
- কণ্ঠস্বরের কর্কশতা
- বমি
- ডায়রিয়া
- খিঁচুনি
- ফুলে যাওয়া
- রক্তচাপ কমে যাওয়া
- চুলকানি, চোখ দিয়ে জল পড়া বা ফুলে যাওয়া
- গলা শক্ত হওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- শ্বাস নেওয়ার সময় শব্দ হওয়া
ত্বকে ফুসকুড়ি, অনিয়ন্ত্রিত হাঁচি এবং শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণগুলির সাথে প্রায়ই ঋতুভিত্তিক পরিবর্তন বা পরাগ অ্যালার্জিকে গুলিয়ে ফেলা হয়। লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে দেখা দেওয়া লক্ষণগুলি শিশুটির তরফে সম্প্রতি খাওয়া খাবারের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে। খুব কম পরিমাণ খাবার থেকেও প্রাণঘাতী অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, তাই এটি দেখা দিলে কী করণীয়, সে ব্যাপারে জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এক-একটি সেকেন্ডও গুরুত্বপূর্ণ, তাই আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং অবিলম্বে আপনার ডাক্তারকে জানাতে হবে।
ভারতে উপলব্ধ সাধারণ অ্যালার্জেন
অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবথেকে সাধারণ খাবারের মধ্যে চিনাবাদাম, দুধ, ডিম, সয়া, গম, গাছে উৎপাদিত বাদাম এবং মাছ পড়ে এবং এগুলি প্রায় 90% ফুড অ্যালার্জির জন্য দায়ী। ভারতে দেখা যায় এমন সাধারণ ফুড অ্যালার্জিগুলি নিম্নরূপ:
- চিনাবাদাম - চিনাবাদাম, গ্রাউন্ডনাট ও এইসব উপাদানযুক্ত যে কোনও খাদ্যদ্রব্য কয়েকটি শিশুর মধ্যে মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কয়েকজনের ক্ষেত্রে তা সারাজীবনের জন্য থেকে যেতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে নাক দিয়ে জল পড়া, ত্বকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া, হজমে সমস্যা এবং শ্বাসকষ্ট।
- দুধ - গরুর দুধে অ্যালার্জি, যা গরুর দুধের প্রোটিন অ্যালার্জি নামেও পরিচিত, তা সাধারণত ভারতীয় শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। গরুর দুধে থাকা কেসিন ও হোয়ে প্রোটিনের কারণে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এই অ্যালার্জি হজমকে প্রভাবিত করে, যার ফলে পেটে খিঁচুনি, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরে গরুর দুধ খেলে আর অ্যালার্জি হয় না, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবেও এই সমস্যায় ভুগে থাকে। গরুর দুধের পরিবর্তে অন্যান্য দুধ যেমন আমন্ড বাদামের দুধ বা আমন্ড মিল্ক, চালের দুধ বা রাইস মিল্ক ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে। তবে এই বিকল্পগুলো পুষ্টিগত দিক থেকে সমধর্মী নয়। যে সব শিশুরা অন্যান্য ধরনের দুধ পান করে তাদের খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের পুষ্টিগত ঘাটতি পূরণের জন্য সামঞ্জস্য করার প্রয়োজন হতে পারে। আপনার সন্তানের এমনকি চিজ, পনির, খোয়া ইত্যাদি দুগ্ধজাত খাবারেও অ্যালার্জি থাকতে পারে। যদিও কয়েকটি শিশু দই ও বাটারমিল্কের মতো গাঁজন করা দুধের খাবার হজম করতে পারে।
- ডিম - ওভুমিউকয়েড, ওভ্যালবিউমিন ও কোনালবিউমিনের মতো ডিমের প্রোটিন কিছু শিশুর মধ্যে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া শুরু করতে পারে। ডিম রান্না করার মাধ্যমে কয়েকটি অ্যালার্জেন নষ্ট করা যেতে পারে। ডিমের পরিবর্তে ইয়োগার্ট ও উদ্ভিজ্জ বিকল্প ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রোটিনের অন্যান্য উৎ যেমন ডাল, মাছ বা মাংস খেতে পারেন।
- মাছ - মাছের প্রোটিন মাঝেমধ্যে কয়েকটি বাচ্চার মধ্যে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়ার সূত্রপাত করতে পারে, এবং রান্না করে ধ্বংস করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ডিম, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাংস, ডাল ইত্যাদির মতো প্রোটিনের বিকল্প উৎস খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারেন।
- গাছ থেকে প্রাপ্ত বাদাম - আখরোট, হেজেলনাট, আমন্ড, কাজু এবং পিস্তার মতো বাদাম কিছু শিশুর মধ্যে মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
- শেলফিশ - চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া এবং ঝিনুক ভারতের অনেক উপকূলীয় জেলায় দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের অংশ। কিন্তু এগুলিতে অ্যালার্জি থাকলে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। অন্যান্য প্রোটিন উৎস যেমন ডিম, মুরগি বা মাংস এই ক্ষেত্রে বাচ্চাদের দেওয়া যেতে পারে।
- সয়াবিন - কয়েকজন শিশু সয়া প্রোটিন হজম করতে পারে না। দুধে অ্যালার্জির ক্ষেত্রে যে লক্ষণ দেখা দেয়, এক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটে। সয়া প্রোটিনের পরিবর্তে অন্য কোনো প্রাণিজ প্রোটিন যেমন মাংস, মাছ বা ডিম খাওয়ানো যেতে পারে। বিনস, মসুর ডাল, মটরশুঁটি, চিনাবাদাম ইত্যাদির মতো খাবারও এড়িয়ে চলতে হবে।
- গম - গমে অ্যালার্জি হয় গমের প্রোটিনের প্রতি ইমিউন-মেডিয়েটেড এলার্জি প্রতিক্রিয়ার কারণে, তবে শিশু অন্যান্য শস্য খেয়ে হজম করতে পারে। মিলেটের মতো ময়দা-জাতীয় দ্রব্যের পরিবর্তে গমজাত খাবার খাওয়া যেতে পারে। যদিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, সুজি, ময়দা, পাস্তা, রুটি এবং এগুলি ছাড়া গম উপস্থিত থাকে এমন অন্যান্য খাবারগুলি শিশুর খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
- তিল - এই বীজগুলির ব্যবহার ভারতে প্রচলিত এবং অন্যান্য বিকল্প যেমন শণ বীজ, কুমড়ো বীজ ইত্যাদি এর পরিবর্তে খাওয়া যেতে পারে।
- ফল ও সবজি - এগুলো সাধারণত হালকা উপসর্গ সৃষ্টি করে, তাই খাওয়ার আগে ফল বা সবজি গরম করে নিলেই এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
- মশলা - বিভিন্ন ধরনের মশলার ব্যবহার ভারতীয় খাওয়া-দাওয়ায় প্রচলিত, তবে অল্প কিছু খাবারে অ্যালার্জি হতে পারে। অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সাধারণত মৃদু হয়, তবে কয়েকটি শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুতর হতে পারে। যে সব মশলার কারণে অ্যালার্জি হয়, সে সব মশলার বদলে ভেষজ বা অন্য মশলা ব্যবহার করা যেতে পারে, যেগুলি একই রকম স্বাদ বা সুগন্ধ জোগায়। সর্ষে, ধনে, রসুনের মতো মশলা খাবারে অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
- ভুট্টা - এই অ্যালার্জিটি ভুট্টা-ভিত্তিক খাদ্যদ্রব্যের কারণে হতে পারে। তবে ভুট্টার বিভিন্ন ধরনের বিকল্প পাওয়া যায়। ভুট্টা অথবা বেকিং পাউডার, সুজি, ক্যারামেল, ভ্যানিলা এক্সট্র্যাক্টের মতো ভুট্টা থেকে প্রাপ্ত দ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে।
অ্যালার্জির লক্ষণগুলি প্রায়শই অন্যান্য চিকিৎসাজনিত সমস্যার লক্ষণগুলির অনেকটাই অনুরূপ হয়। তাই শিশুদের সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য সব সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ফুড অ্যালার্জির কোনো চিকিৎসা না থাকলেও স্বাস্থ্যে মারাত্মক পরিণতি ঠেকাতে কয়েকটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।