কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। পর্যাপ্ত ঘুমের ফলে বয়ঃসন্ধিকালে মস্তিষ্কের বিকাশ ও কর্মক্ষমতা, মনোযোগের মাত্রা এবং সামগ্রিক জ্ঞানীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

প্রত্যেক মানুষেরই উত্তম ঘুমের প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের শরীরকে সর্বোত্তমভাবে কাজ করার জন্য শক্তি যোগাতে পারে, এবং কিশোর-কিশোরীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং টিনএজারদের জন্য সঠিক ঘুম আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি তাদের শারীরিক গঠনের এই সময়টিতেই অধিক হয়। টিনএজারদের জন্য ঘুমের পর্যাপ্ত সময় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কারণ টিনএজারদের ঘুমের অভাব বা অনিদ্রা তাদের মানসিক, শারীরিক, হরমোন এবং আবেগগত বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে।

কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ ও জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যও পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের কাছে ঘুম যেন খুব অহীনার বস্তু, যেটি তাদের শিক্ষাগত ও খেলাধুলার দক্ষতা, মনোযোগের ব্যাপ্তী, এমনকি তাদের মানসিক অবস্থা ও আচরণকেও ঝুঁকি পূর্ণ করে তোলে।

যে বিষয়গুলো আপনার ঘুমের চক্রকে প্রভাবিত করে থাকে

টিনএজারদের মধ্যে ঘুমের অভাবের পেছনে একাধিক কারণ থাকে, যা টিনএজদের মধ্যে অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া নামেও পরিচিত, এবং এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।

1. অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস

ঘুমের প্রতি আগ্রহ অত্যন্ত কম থাকায় এবং ঘুম-প্রবর্ধক হরমোন মেলাটোনিনের কম উত্পাদনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের জন্য ঘুমের সঠিক সময়সূচি নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হতে পারে। তাছাড়া, কিশোর-কিশোরীদের গভীর রাত পর্যন্ত জেগে কোনো একটা কিছু নিয়ে সময় কাটানোর অভ্যাসের কারণে তাদের পক্ষে ঘুমানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এরফলে তাদের সার্কাডিয়ান ছন্দ এবং ঘুমানো-জাগার চক্রের উপর কতটা কুপ্রভাব পড়ে সেটি তারা উপলব্ধি করতে পারেনা।

সাধারণত, বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায়। তাই কিশোর-কিশোরীরা রাত 1টারও পরে ঘুমাতে গেলেও সকাল 7টা বা 8টায় ঘুম থেকে ওঠা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। এর ফলে কিশোর-কিশোরীদের বিশ্রামের জন্য, বিনোদনের জন্য এবং তাদের শক্তি ভান্ডারগুলিকে পুনরায় পূর্ণ করার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের সময় থাকে না। অনেকে এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সপ্তাহান্তে তাদের ঘুমানোর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার চেষ্টা করে, যা পকারান্তরে তাদের রাতে ঘুমের সময়ের অসঙ্গতিকে বরং আরও বাড়িয়ে তোলে এবং সময়সূচিকে বিলম্বিত করে।

2. প্রচুর কাজের চাপ

আপনি নিশ্চই কিশোর-কিশোরীদের প্রায়ই এমনটা অভিযোগ করতে শুনেছেন যে তাদের নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। ঘরের কাজ, প্রজেক্টের কাজ এবং কাজের বাধ্যবাধকতা থেকে শুরু করে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, পার্টি করা, খেলাধূলা করা এবং ঘরের কাজ করার মতো নানান বিষয়ই তাদের বজায় রাখতে হয়। এত কিছু করার পর যেটি অবহেলিত হয় সেটি হল স্বাস্থ্যকর ঘুমের রুটিন। কখনও অ্যাসাইনমেন্ট, কখনও সোশ্যালাইজিং, মুভি বা মি-টাইমের কারণে গভীর রাতে তাঁদের জেগে থাকতে হয়, যা টিনএজারদের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্কে ইতি টানে।

3. ইলেকট্রনিক যন্ত্র

বর্তমানে মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট ছাড়া জীবন কল্পনা করা বেশ কঠিন। কিন্তু গভীর রাতে এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সঙ্গে সময় নষ্ট করা কি খুব জরুরি? দুটি জাতীয় সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, 2015 সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে ঘুম থেকে বঞ্চিত ছিল। 2019 সালের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, 68 শতাংশ কিশোর-কিশোরী রাতে তাদের ফোন হাতের কাছেই রাখে। প্রতিনিয়ত এই ডিভাইসগুলি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্ক বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে নিমজ্জিত থাকে এবং বিজ্ঞপ্তিগুলি বারবার তাদের ঘুমকে বিঘ্নিত করে। এছাড়া এসব ডিভাইস থেকে নির্গত নীল আলো শরীরের মেলাটোনিন উত্পাদনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার প্রভাব টিনএজারদের ঘুমের চক্রের উপর পড়ে ।

4. বিকার ও মানসিক সমস্যা সমূহ

টিনএজারদের ঘুমের ব্যাধিগুলির মধ্যে অন্যতম হল অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম, দিবানিদ্রা এবং নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধি যেমন অ্যাটেনশন-ডেফিসিট / হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার এবং অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ইত্যাদি। এই ব্যাধীগুলি রাত্রীকালীন ঘুমকে একটি চ্যালেঞ্জ করে তুলতে পারে। টিনএজারদের মধ্যে অনিদ্রা বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মত মানসিক অবস্থা থেকেও উদ্ভূত হতে পারে, যার ফলে তাদের ঘুমের ধরন বাধাগ্রস্ত হয়।

সঠিক খাদ্য কীভাবে আপনার ঘুমের ধরনকে উপকৃত করতে পারে

ঘুমের অভাব এবং উচ্চ BMI এবং টিনএজারদের অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য অবস্থার মধ্যে একটি যোগসূত্র পাওয়া গেছে; তাদের খাদ্য পছন্দগুলি এটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানকারীদের মধ্যে অন্যতম। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যে কিশোর-কিশোরীরা দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকে তাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। এই সব গবেষণায় পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে, কারণ আপনি দিনে যা খান তা রাতে ঘুমের গুণগত মানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। NLM একটি গবেষণায় কম ফাইবার, উচ্চ চিনি এবং উচ্চ সম্পৃক্ত ফ্যাট গ্রহণ এবং কম পুনরুদ্ধারকারী ঘুমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এটি প্রমাণ করা হয়েছে।

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য
    একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার মানুষকে ভালো ঘুম এবং আরও অনেক স্বাস্থ্যগত সুবিধা প্রদান করতে সক্ষম। কিশোর-কিশোরীদের এই অনিদ্রা দূর করতে এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। ফাইবার সমৃদ্ধ যে খাবারগুলি টিনএজারদের ঘুমের সময়ে অবদান রাখতে পারে তার কিছু উদাহরণ হল আঙুল বাজরা (রাগি), কালো শিম, আলু, তেঁতুল, বেগুন, ডাল, আপেল, কলা, নাশপাতি এবং বাদাম।
  • পাতাযুক্ত সবজি, গোটা শস্য ও ফল
    পাতাযুক্ত সবজি, বাদাম এবং গোটা শস্য ম্যাগনেসিয়ামের উত্তম উত্স। এই খাবারগুলো মাংসপেশি শিথিল করতে এবং ঘুমের মান বাড়াতে সহায়তা করে। ম্যাগনেসিয়ামের মতো পটাশিয়ামও ঘুমানোর ধরনের উন্নতি ঘটায় । কলা, অ্যাপ্রিকোট, আলুর মতো পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের ভালো সময় দিতে পারে।
  • জল
    সারাদিন জল পান করলে ভালো ঘুম হয়। আপনার শরীর জলের জন্য আকুল হলে, আপনি ঘুমানোর সময় শ্বাসকষ্ট এবং পায়ের ক্র্যাম্প অনুভব করতে পারেন, যা ডিহাইড্রেশনের ইঙ্গিত দেয়।
  • কাঠবাদাম
    কাঠবাদাম আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে পারে কারণ এটি মেলাটোনিন এবং ম্যাগনেসিয়ামের একটি দুর্দান্ত উত্স, যা প্রদাহ হ্রাস করে ঘুমের উন্নতিতে সহায়তা করে। ঘুমানোর আগে একমুঠো কাঠবাদাম আপনাকে অনায়াসে ঘুমের দেশে নিয়ে যাবে।
  • চ্যামোমিল চা
    চ্যামোমিলের মধ্যে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েড, যার কারণে ঘুমের মান উন্নত হতে পারে। 2011 সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দিনে দু'বার চ্যামোমিল চা খেলে অংশগ্রহণকারীরা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন এবং তাদের ঘুম ভালো হয়।

ভিটামিন A, B, C, D, E, K এবং বিভিন্ন খনিজ যেমন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আয়রনের মতো পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ ডায়েট আপনার সামগ্রিক শরীরের কার্যকারিতা এবং ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। ব্রকোলি এবং পাতাযুক্ত সবুজ শাক-সবজি ভিটামিন B এর চমত্কার উত্স; লাল মাংস, যকৃত্, তৈলাক্ত মাছ এবং ডিমের কুসুম ভিটামিন D এর সংগ্রহস্থল এবং সয়াবিন তেল, বাদাম এবং চিনাবাদাম ভিটামিন E. এর সমৃদ্ধ উত্স।

একজন কিশোরের জন্য যতটা ঘুমের পরামর্শ দেওয়া হয়

কিশোরদের জন্য দৈনিক সুপারিশকৃত ঘুমের সময় হল 8 থেকে 10 ঘন্টা যাতে তাদের শারীরিক ক্রিয়াগুলির সঠিক পরিচালনা নিশ্চিত হয়। টিনএজারদের জন্য স্বাস্থ্যকর ঘুমের সময় অবশ্যই প্রয়োজন কারণ তারা তাদের শরীর গঠনের সময়ের মধ্যে রয়েছে এবং পর্যাপ্ত ঘুম তাদের সামগ্রিক বিকাশকে উন্নত করতে সাহায্য করে, যার মধ্যে তাদের বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে।

নিচের টিপসগুলো কিশোর-কিশোরীদের ঘুম উন্নত করতে সাহায্য করবে

  • প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠা ও ঘুমানোর একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন: সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের যদি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠা কঠিন বলেও মনে হয়, তবুও তাদের সেই তালিকা মেনে চলার জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত।
  • সপ্তাহান্তে হারানো ঘুমের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত কারণ এটি ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করবে।
  • ঘমানোর রুটিন: টিনএজাররা এমন কিছু রুটিন মেনে চলতে পারেন, যা তাদের ভালো ঘুম এনে দিতে পারে। যেমন- গরম জল দিয়ে স্নান করা, এক গ্লাস গরম দুধ পান করা, যোগব্যায়াম করা ইত্যাদি।
  • সূর্যাস্তের পর উদ্দীপক গ্রহণের মাত্রা পরীক্ষা করুন: সূর্যাস্তের পর চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কস, সফট ড্রিঙ্কসের মতো উত্তেজক উপাদান গ্রহণ করলে ঘুমের সময় পার হওয়ার অনেক পরে আপনার বডি ক্লক কাজ করা শুরু করতে পারে।
  • গতানুগতিক বই/পত্রিকার আকর্ষণীয় গল্পগুলি পড়লে সেটিও ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

উপসংহার

টিনএজারদের ঘুমের গুরুত্ব কিছু কম নয়। সঠিক ঘুমের চক্র অর্জন করা কোন কঠিন কাজ নয়, কিন্তু অন্য যে কোন অভ্যাসের মতই এটিও একটি অভ্যাস যা টিনএজরা খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলে। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। সুতরাং, কিশোরদের অবশ্যই তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে বিমুখি হলে চলবে না, কারণ তাদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ঘুমের মান এবং পরিমাণ উভয়ই বজায় রাখা অপরিহার্য। এই প্রবন্ধে যেমনটা আলোচনা করা হয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের জন্য উপযুক্ত ঘুমের দীর্ঘমেয়াদী উপকারিতা হল অসংখ্য; তাদের শারীরিক থেকে মানসিক বিকাশে, ঘুমের একটি সর্বাত্মক প্রভাব রয়েছে।