পাকস্থলী ও অন্ত্রের সংক্রমণ বা গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হল 1 থেকে 5 বছর বয়সী শিশুদের একটি সাধারণ স্বাস্থ্যগত সমস্যা। যদিও এটি এমন একটি অসুস্থতা যা প্রায়ই দ্রুত সমাধান হয়ে যায়, তবে বাবা-মায়েদের জন্য বিশেষ করে এটি ভীতিকর ও বিভ্রান্তিকর হতে পারে, যেহেতু তারা বুঝতে পারে না কীভাবে তাদের অসুস্থ সন্তানের যত্ন নিতে হয়। তাই বাবা-মা হিসেবে আপনাদের এই সংক্রমণগুলোর লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো সম্পর্কে বুঝতে হবে।

শিশুদের পেটে সংক্রমণ নতুন কোনও বিষয় নয়। প্রায়শই 'স্টমাক ফ্লু' হিসাবে পরিচিত হওয়া এই সমস্যাটি পরিপাক বা পাকস্থলীর একটি অসুস্থতা, যার লক্ষণগুলি সাধারণত ডায়রিয়া, বমি এবং পেট ব্যথা। গুরুতর অনুপযুক্তভাবে পরিচালিত পরিস্থিতিতে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, কারণ বমি এবং ডায়রিয়ার মাধ্যমে শরীর প্রচুর পরিমাণে তরল হারায়। পাকস্থলী ও অন্ত্রের সংক্রমণ মূলত ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, ভাইরাস এবং অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর কারণে হয়। শৈশবকাল থেকেই মাঝে মাঝে পেটে সংক্রমণ হতে পারে। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে রোটাভাইরাল সংক্রমণের কারণে সাধারণত গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হয়।

শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের প্রবণতা বেশি, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পুরোপুরি বিকশিত নয়। এছাড়াও, তারা রোগের জীবাণুর সংস্পর্শে আসে কারণ তারা খাওয়ার আগে হাত ধোয়া বা হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখার মতো মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির রুটিনগুলি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। এছাড়া, স্কুলে পড়ার সময় বা বাইরে খেলার সময় তারা অস্বাস্থ্যকর বা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সম্মুখীন হয়। শিশুরা প্রায়ই আক্রান্ত হয়, যখন তারা:

  • দূষিত খাবার, বিশেষ করে কাঁচা ও সেদ্ধ না করা ডিম, মাংস বা শেলফিশ খায়।
  • কল, কূপ ইত্যাদি উন্মুক্ত উৎস থেকে দূষিত জল পান করে।
  • পথে থাকা ব্যাকটেরিয়া বাহক পশুদের সাথে খেলা করে।
  • অপরিষ্কার জল বা পাস্তুরাইজ না করা দুধ দিয়ে তৈরি জুস পান করে।
  • দীর্ঘক্ষণ খোলা অবস্থায় পড়ে থাকা খাবার যেমন বুফে খাবার এবং ফ্রিজে থাকা খাবার খায়। এসবে খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়।

যে-সব লক্ষণের প্রতি নজর রাখতে হবে:

আপনার শিশুর গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস আছে কিনা তা জানতে নিচের লক্ষণগুলোর প্রতি খেয়াল রাখুন:

  • জ্বর, বমি বা ডায়রিয়া হলে
  • আপনার সন্তানকে অস্বাভাবিকভাবে খামখেয়ালী মনে হলে
  • পেটে ব্যাথা আচমকা শুরু হলে বা থেমে গেলে
  • খিদে কমে গেলে
  • মলের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিলে
  • চরম ক্লান্তি বোধ করলে

প্রধান উদ্বেগের বিষয় হল এই সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুরা বমি এবং/অথবা ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে তরল পদার্থ হারিয়ে যাওয়ার কারণে ডিহাইড্রেটেড হয়ে যেতে পারে। তাই এমন লক্ষণগুলি সন্ধান করুন যেগুলির ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসকের নজরদারি প্রয়োজন হতে পারে, যেমন প্রচুর জ্বর, কম প্রস্রাব, চরম তৃষ্ণা, দুর্বলতা এবং এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শুকনো মুখ বা ঠান্ডা হাত ও পা।

সন্তানকে সুস্থ রাখতে কী করতে পারেন?

আপনার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বমি বা পেটে ব্যথা সামলানোর জন্য কিছু ওষুধ লিখে দিতে পারেন। আপনার সন্তানকে এগুলি দেওয়া ছাড়াও, সবচেয়ে ভাল হয় যদি খুব অল্প পরিমাণে কয়েক মিনিট অন্তর তরল খাওয়ানো যেতে পারে। তরল পদার্থ পান করার মাধ্যমে সে ভাল অনুভব করতে এবং ডিহাইড্রেশন এড়াতে পারবে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পরামর্শ দিয়ে থাকেন:

  1. মেইনটেন্যান্স ফ্লুইড বা পরিমিত তরল খাবার খাওয়াতে থাকুন - এটি তরলের সেই পরিমাণ, যা একটি শিশু সুস্থ থাকা অবস্থায় সারা দিনে পান করে।
  2. রিপ্লেসমেন্ট ফ্লুইড বা প্রতিস্থাপক তরল- এর অর্থ হল যে পরিমাণ তরল সে বমি বা ডায়রিয়ার মাধ্যমে হারাচ্ছে তার পরিমাণ প্রতিস্থাপন করা।

কোনও শিশু নিয়মিত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সংক্রমণে ভুগলে খাবার-দাবারের নির্দেশিকা

খিদে বা বমিজনিত কারণে পাকস্থলী ও অন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুকে খাবার খাওয়ানো চ্যালেঞ্জের বিষয় হতে পারে। যদিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সঠিকভাবে খাওয়া এবং সঠিক ধরণের খাবার অন্ত্রের অভ্যন্তরীণ আস্তরণগুলিকে দ্রুত নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে। দেখা গেছে যে, খাবার এড়িয়ে গেলে ডায়রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে।

শিশুকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাওয়ানো হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা আপনি আপনার শিশুকে জলশূন্যতা থেকে রক্ষা করতে এবং সুস্থতায় সহায়তা করতে খাওয়াতে পারেন। শিশুদের প্রচুর পরিমাণে পানীয় জল, ডাবের জল, পাতলা বাটারমিল্ক বা ওরাল রিহাইড্রেশন ফ্লুইড খাওয়াতে হবে। দুধ সব শিশুর হজম নাও হতে পারে, তাই আপনি চাইলে এটি বাদ দিতে পারেন। এর বদলে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ দই খাওয়াতে পারেন। যদি আপনার সন্তানের বমি বমি ভাব হতে থাকে, তাহলে প্রতি 4-5 মিনিট অন্তর এক চামচ করে তরল খাওয়ানো সহায়ক হতে পারে।

যদি আপনার শিশু তরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় তবে প্রথমে মশলাহীন খাবার অল্প পরিমাণে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা শিশুকে কঠিন খাবার ভাল করে সহ্য করতে সাহায্য করবে। ইডলি, মুগ ডালের খিচড়ি, দই ভাত, জল বা বাটারমিল্ক দিয়ে তৈরি ওটস পোরিজ, ডাল ও সবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ, কম তেল বা ফ্যাট দিয়ে তৈরি চর্বিহীন মাংস, কম ফ্যাটযুক্ত মাছ, সেদ্ধ ডিম, কলা, রান্না করা সবজি যেমন লাউ, আলু , কুমড়া, রুটি এবং ইয়োগার্ট হল কয়েকটি ভাল বিকল্প। কঠিন পদার্থের প্রতি সহনশীলতা বাড়ানোর পরে আপনি ধীরে ধীরে শিশুকে দেওয়া খাবারের পরিমাণ বাড়াতে পারেন।

আপনার বাচ্চাকে তেলেভাজা খাবার বা মশলাদার খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন। দুগ্ধজাত খাবার যেমন চিজ, পনির, আইসক্রিম এবং চিনিযুক্ত খাবার যেমন কেক, ক্যান্ডি এবং ললিপপগুলি গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের সময় এড়ানো ভাল।

ছোটদের জন্য এই স্বাস্থ্যকর রেসিপিটি বানাতে পারেন:

কুমড়োর খিচড়ি হল সঠিক ধরণের খাবার যা আপনি আপনার বাচ্চার পেটের সংক্রমণের প্রতিকার হিসাবে পরিবেশন করতে পারেন। সহজে রান্না করা যায় এবং স্বাস্থ্যকর এই খাবারটি রোজকার চাল, লাল কুমড়ো এবং ডাল দিয়ে তৈরি করা হয়।

উপকরণ:

  • চাল - ¾ কাপ
  • মুগ ডাল - ¼ কাপ
  • পেঁয়াজ কুচি - 1/2
  • রসুন কুচি - 1টি বা 2টি
  • হলুদ গুঁড়ো - ⅛ চা-চামচ
  • নুন - প্রয়োজন মতো
  • লাল কুমড়ো - 1 কাপ ছোট টুকরো করে কাটা
  • জল - 3 কাপ
  • ঘি - 2 চা-চামচ

প্রস্তুতি পদ্ধতি:

  • চাল ও মুগ ডাল পরিষ্কার করে 20 মিনিট মতো গরম জলে একসাথে ভিজিয়ে রাখুন।
  • প্রেসার কুকারে এক চা চামচ ঘি দিয়ে গরম করে তাতে রসুন কুচি দিন।
  • এরপর তাতে পেঁয়াজ কুচি দিন। লালচে না হওয়া পর্যন্ত ভাল করে ভেজে নিন।
  • পেঁয়াজ লালচে হয়ে এলে তাতে লাল কুমড়ো, হলুদ গুঁড়ো ও নুন দিয়ে কষিয়ে নিন।
  • তারপর তাতে ভিজিয়ে রাখা চাল ও তুর ডাল দিয়ে খুব দ্রুত নাড়াচাড়া করে ভালো করে মিশিয়ে নিন।
  • জল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। প্রেসার কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে দিন এবং তিন-চারবার সিটি ওঠা অব্দি মাঝারি আঁচে রান্না করুন। বাষ্পচাপ বেড়িয়ে গেলে কুকার খুলে নিন এবং নরম হওয়া পর্যন্ত একটি ম্যাশার দিয়ে ভালো করে ম্যাশ করে নিন।
  • তাজা ও গরমাগরম পরিবেশন করুন।