কোনও নির্দিষ্ট ফুড আইটেম পুষ্টিকর কিনা তা নির্ধারণ করা অনেক সময় সমস্যাজনক হতে পারে। আর ঘি এমনই এক ধরনের খাবার। ঘি বহুকাল ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, কারণ এটি ভারতে একটি বহুল ব্যবহৃত চর্বির উৎস। যুগ যুগ ধরে খাঁটি ঘরে তৈরি ঘি ভারতীয় খাদ্যের একটি অপরিহার্য অংশ এবং অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু খাবারে ব্যবহৃত হয়। আপনার ডালে অতিরিক্ত স্বাদ যোগ করা থেকে শুরু করে শুকনো রুটিতে সুস্বাদ যোগ করা, সবেতেই ঘির ভূমিকা অপরিসীম। তবে বর্তমানে বাজারে প্রচুর রিফাইনড কুকিং অয়েল পাওয়া যাওয়ায়, মানুষজন ঘি স্বাস্থ্যকর কিনা এবং এতে থাকা পুষ্টির মান নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন।

তাই আজকাল কয়েকজন এই ধারণায় বিশ্বাসী যে ঘি শিশুদের জন্য উপকারী এবং সহজে হজম হয়ে যায়, আবার অন্যরা বিশ্বাস করেন যে শিশুদের ঘি খাওয়া এড়ানো উচিত। যদিও এর মাঝামাঝি কোথাও আসল সত্যি লুকিয়ে।

ঘি: জনশ্রুতি বনাম প্রকৃত সত্য

জনশ্রুতি 1: দেশি ঘি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর

ঘি স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ- এই জাতীয় কিছু গুজব গত বেশ কিছু দশক ধরে প্রচলিত থাকলেও, ব্যাপারটা আদৌ সত্য নয়। খাঁটি ঘিতে থাকা প্রায় 32% ফ্যাটই হল মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (MUFA), যা 'স্বাস্থ্যকর ফ্যাট' নামে পরিচিত।

এছাড়াও, ঘিতে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। এতে ভিটামিন A, D E ও K-এর মতো ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন রয়েছে, যা শিশুদের সুস্থ হাড় ও মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্যে করে। উপরন্তু অনেক কুকিং অয়েলের তুলনায় ঘির স্মোকিং পয়েন্ট বেশি। এর মানে, এটি মুক্ত মৌলে বা ফ্রি র‍্যাডিকেলে বিভাজিত হয় না। ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলি আপনার সন্তানের দেহে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং এমনকি শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

জনশ্রুতি 2: ঘি শৈশবকালীন মেদবৃদ্ধি ঘটায়

বাবামায়েরা প্রায়শই তাদের বাচ্চাদের ঘি দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকেন, কারণ তারা ভয় পান যে এটি খেলে ওজন ও মেদ বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ঘি প্রকৃতিতে লাইপোলিটিক, অর্থাৎ এটি আসলে অন্যান্য খাবারে উপস্থিত ফ্যাটকে ভেঙে দেয়, যার ফলে হজম এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। ঘি CLA (কনজুগেটেড লাইনোলেইক অ্যাসিড) সমৃদ্ধ, যা হার্টের পক্ষে ভালো এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই পরিমিত পরিমাণে খেলে ঘি হজমকে উদ্দীপিত করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

জনশ্রুতি 3: শিশুরা যেকোনও পরিমাণ ঘি হজম করতে পারে

কিছু মানুষ এমনও আছেন যারা চরম পর্যায়ে চিন্তাভাবনা করে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন যে ঘি যেহেতু তাদের বাচ্চাদের পক্ষে ভালো, তাই তারা যে কোনও পরিমাণ ঘি হজম করতে সক্ষম। সত্যিটা হল এই যে, অতিরিক্ত খাওয়া হলে যে কোনও খাবারই ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং ঘি অবশ্যই এর ব্যতিক্রম নয়। ঘিতে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট থাকে, তাই শিশুরা কতটা পরিমাণে খাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে, ঘি কি আপনার সন্তানের খাদ্যে যোগ করা উচিত?

হ্যাঁ, ঘিতে প্রচুর পরিমাণে নিউট্রিয়েন্ট রয়েছে, যেগুলি আপনার বাড়ন্ত সন্তানের নিয়মিত খাওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি আপনার সন্তানের খাদ্যতালিকায় ঘি অন্তর্ভুক্ত করার সময় আপনাকে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন:

শিশুদের ঘি খাওয়ানোর দৈনিক পরিমাণ

FAO (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) অনুযায়ী, একজন গড়পড়তা শিশুর প্রতিদিন 1000 থেকে 1500 ক্যালোরির প্রয়োজন হয় এবং এর 30% ফ্যাট থেকে আসা উচিত। যদিও এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আপনার সন্তানকে ফ্যাটের জোগান দিতে ঘি-ই একমাত্র উৎস নয়। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আপনার সন্তান দুধ ও চিজের মতো অন্যান্য ফ্যাট-সমৃদ্ধ খাবারও খেয়ে থাকে। তাই তার ঘি খাওয়ার পরিমাণ আপনার নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। ছোট বাচ্চাদের দিনে 1 টেবিল চামচের বেশি ঘি খাবারে যোগ করা উচিত নয়, তবে সামান্য বড় বাচ্চাদের প্রতিদিন 2-3 টেবিল চামচ খাবারে যোগ করা যেতে পারে।

কীভাবে আপনার সন্তানের খাবারে ঘি অন্তর্ভুক্ত করবেন?

আপনার সন্তানের ডায়েটে ঘি যোগ করার সর্বোত্তম উপায় হল আপনার সন্তানের পছন্দের খাবারগুলিতে ঘি মেশানো।

  • বাটি ভর্তি গরমাগরম ডালে সামান্য ঘি যোগ করা যেতে পারে এবং ভাতের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে।
  • আরেকটি সবসময়ের পছনের উপায় রুটিতে ঘি ও গুঁড়ো করা গুড় যোগ করা এবং সেটি রোল করে আপনার সন্তানকে বেলা বা বিকেলের স্ন্যাক্স হিসাবে খেতে দেওয়া।
  • আটা হালুয়া হল আরেকটি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর রেসিপি যা বেশিরভাগ বাচ্চারা খেতে পছন্দ করে। 1 চা চামচ ঘি গরম করে 2 চা চামচ আটা (গম-ভাঙানি আটা) ভেজে নিন। আটা গোল্ডেন-ব্রাউন কালারের হয়ে গেলে, 1.5 কাপ গরম জল যোগ করুন। যতক্ষণ না জল শুষে গিয়ে হালুয়া তৈরি হয়, ততক্ষণ নাড়তে থাকুন।

উপসংহার

ঘিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক থাকলেও, বলা যায় যে ঘি হল ভারতের আসল সুপারফুড। এটি আপনার সন্তানের সঠিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই অত্যাবশ্যক। পরিমিত পরিমাণে খাওয়াতে থাকলে, আপনার সন্তানের রোজকার ডায়েটে ঘি যোগ করা নিয়ে আর কোনও চিন্তা থাকে না।