যদিও হরমোননের মাত্রার উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে তীব্র ওঠানামা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। জেনে নিন, কোন খাবারগুলি হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলে এবং কোন কোন খাবার খেলে তা ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে!
ডায়েট যেভাবে হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলে
বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন সংকেত সূচক অণু্কণা হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কোষ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পারস্পরিক যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়। এভাবেই দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত হয়। জীবকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশের যে কোনও পরিবর্তনে উপযুক্তভাবে সাড়া দিতে সক্ষম করার জন্য তার দেহের অভ্যন্তরে যোগাযোগ ব্যাবস্থা অপরিহার্য।
আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আমরা খাদ্য থেকে পাই, এবং সবরকমভাবে উত্তম উপায়ে কাজ করার জন্য আমরা আমাদের খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। একইভাবে, হরমোনের ভারসাম্যরক্ষাকারী খাদ্যও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কারণ খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি এবং পুষ্টিগুলি শরীরকে নির্দিষ্ট হরমোনগুলি সংশ্লেষিত করতে এবং তাদের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে সহায়তা করতে সক্ষম।
- খাদ্যের সাথে সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বিষয় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণ হতে পারে এবং এর ফলে ফুড অ্যালার্জি, শরীরের ওজনে পরিবর্তন, খারাপ খাদ্যাভ্যাস ও অলস জীবনযাপনের কারণে প্রদাহ, ঘুমের ধরন, হজম সমস্যা, ইত্যাদি বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
- খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পদার্থগুলি নির্দিষ্ট কিছু অণুকে সক্রিয় করে তোলে এবং শক্তি ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট প্রদাণ করে। তাই এককথায় খাবারকে হরমোন এর ককটেল বলা যেতে পারে।
- উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য ঘারিলিনের মতো হরমোনের ক্রিয়া পরিবর্তন করে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে যার ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়।
- বৃদ্ধি এবং প্রজননের সাথে জড়িত সমস্ত স্টেরয়েড হরমোন কোলেস্টেরল থেকে আসে, যেগুলি আমরা আমাদের খাদ্য থেকে পেতে পারি, তবে এগুলি আমাদের শরীরে অন্তর্জাতভাবেও উত্পাদিত হয়, আর এতে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
- পলিফেনল নামক কার্যকরী যৌগ সমৃদ্ধ উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্য গ্রহণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতার বিরুদ্ধে কাজ করতে সাহায্য করতে পারে।
হরমোন ভারসাম্যহীন কি না সেটি কীভাবে বুঝবেন
নীচের তালিকাটি লক্ষণগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয় যার দ্বারা এটা বোঝা যায় যে হরমোনগুলি ভারসাম্যহীন কিনা। তবে যদি আপনার মনে হয় যে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দিয়েছে, তাহলে অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
- দুশ্চিন্তা ও ঘুমের ব্যাঘাত: অতিরিক্ত ব্যায়াম এবং কম চর্বি বা কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার থেকে হওয়া শারীরিক চাপের কারণে ইস্ট্রোজেন হরমোন ওঠানামা বা হ্রাস উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
- প্রস্রাব সংক্রমণ:অতিরিক্ত চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ এবং ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি6 বা জিংকের ঘাটতির কারণে প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমে যেতে পারে, যার কারণে নারীদের যোনিতে শুষ্কতা, মূত্র সংক্রমণ, জয়েন্টে ব্যথা এবং ওজন বৃদ্ধি হতে পারে।
- শুরুর দিকের বয়ঃসন্ধি: বয়ঃসন্ধি হল সেই সময় যখন একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। বাতাসের বিষাক্ত পদার্থ থেকে সৃষ্ট পরিবেশগত ইস্ট্রোজেন শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে, যা সময়ের পূর্বে, 8-9 বছর বয়সেই বয়ঃসন্ধির দিকে নিয়ে যায়।
- ওজন কমে বা বেড়ে যাওয়া: আমাদের শরীর কতটা শক্তি ব্যবহার করে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড হরমোন। এটির ক্ষরণ কমে গেলে ওজন বৃদ্ধি, বিষণ্নতা, চুল পড়া, শক্তি হীনতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শুষ্ক ত্বক এবং ঠান্ডা সহ্য করতে না পারার মতো সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, এই হরমোনের বৃদ্ধির কারণে ওজন হ্রাস পায়, বর্ধিত বিপাকের কারণে উচ্চ শক্তি নির্গমণ হওয়ায় শরীর সারাক্ষণ উষ্ণ থাকে এবং ডায়রিয়া জাতিয় সমস্যার সৃষ্টি হয়। কর্টিসল মাত্রায় ভারসাম্যহীনতার কারণেও ওজন বাড়ে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার অন্যান্য লক্ষণ সমূহ
- দুর্বল স্মৃতিশক্তি
- ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধ
- বিষণ্নতা
- পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS)
- হিরসুটিজম - পুরুষদের মতো মহিলাদের দেহে অতিরিক্ত চুল।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য দায়ী খাদ্য
হরমোন-ভারসাম্যকারী ডায়েট অনেক সুবিধা প্রদাণ করে এবং একটি উত্তম অভ্যন্তরীণ অবস্থা বজায় রাখে। কিছু বিশেষ খাবার হরমোন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে যাতে আমাদের সমস্ত অঙ্গ প্রনালীগুলির সর্বোত্তম কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করা যায়। তবে আমরা উল্লেখ করতে চাই যে এই খাবারগুলি হরমোনের ভারসাম্যহীনতার প্রতিকার হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এগুলি সামগ্রিক পুষ্টি প্রদান করে যা হরমোনের ক্রিয়াকে স্থিতিশীল করতে পারে মাত্র।
হরমোনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য খাদ্যের কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হল:
- গোটা শস্যদানা এবং সবুজ শাক-সবজি: গোটা শস্য যেমন যব এবং গম এবং সবুজ শাক সবজি যেমন পালং শাক এবং মেথিতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার থাকে। এটি উদ্ভিদের সেই অংশ যা এর গঠনগত জটিলতা এবং এটিকে ভাঙার জন্য উপযোগী এনজাইমের অভাবের কারণে আমাদের পাকস্থলী ও অন্ত্র দ্বারা হজম করা যায় না। পরিবর্তে, এই ফাইবার আমাদের অন্ত্রে মাইক্রোবায়োটারের খাদ্য হিসাবে কাজ করে এবং এটি ফার্মেন্টেড হয়ে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (SCFA) তৈরি করে। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি অন্যান্য অণুগুলির সাথে আবদ্ধ হতে পারে এবং লেপটিনের মতো ওজন হ্রাসকারী হরমোনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
- দই: হরমোনের ভারসাম্যের জন্য খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করার সময়, দই-এর মত জীবিত অণুজীব ধারণকারী উপাদানের কথা বিবেচনা করতে হবে। এটা আমাদের অন্ত্রে প্রস্ফুটিত জীবন্ত অণুজীব যা ডায়েটারি ফাইবারকে ভাঙ্গতে এবং উপরে উল্লিখিত উপকারগুলি অর্জন করতে সাহায্য করে।
- মুরগি, ডিম আর মাছ: ব্রাঞ্চেড-চেইন অ্যামিনো অ্যাসিড (BCAAs) মুরগির মাংস এবং ডিমের মতো খাদ্য হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং একাধারে কোষীয় সংকেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, প্রোটিন সংশ্লেষণকে উদ্দীপিত করে এবং কঙ্কাল পেশী ও যকৃতে প্রোটিন ভাঙ্গন রোধ করে। এছাড়াও, প্রোটিন সমৃদ্ধ উত্সগুলি খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে যা বৃদ্ধির হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায় কারণ এগুলি ইনসুলিনের মতো গ্রোথ ফ্যাক্টর(IGF) কে প্রভাবিত করতে পারে আমাদের শরীরের লেভেল সমূহ, যা উচ্চতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মাছ, ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিডের অন্যতম সেরা উত্স -এটি একটি বায়োঅ্যাকটিভ লিপিড যা সংকেতের পথকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। এরা কার্ডিওভাসকুলার ক্রিয়াকে উন্নত করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) বাড়িয়ে দিয়ে PCOS রোগীদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল দেয় ঘটে।
- ব্রকোলি ও অন্যান্য ক্রুসিফেরাস সবজি:ক্রুসিফেরাস সবজিতে রয়েছে সালফারযুক্ত যৌগ যা ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণে উদ্ভুদ পরিবর্তনকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে এবং কার্যকর কেমোপ্রিভেনটিভ এজেন্টের ভূমিকা পালন করে। তাই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা প্রতিরোধের জন্য খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এগুলি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
- সোয়া ও শণ বীজ: সয়াতে রয়েছে ডায়েটারি ফাইটোইস্ট্রোজেন, যা ইস্ট্রোজেনের বৈশিষ্ঠ যুক্ত জৈব-সক্রিয় যৌগ। কিছু প্রাক-ক্লিনিক্যাল গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এই যৌগগুলি হরমোন এবং স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন রজোনিবৃত্তির পরবর্তী পর্যায়ে মহিলাদের রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে উন্নতি এবং কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি নির্ধারণ। প্রাক-রজোনিবৃত্তি এবং উত্তর-রজোনিবৃত্তি পর্যায়ে এগুলির দ্বারা প্রদত্ত সুবিধার কারণে, এরা মহিলাদের হরমোন ভারসাম্যকারী খাবারের মধ্যে বিবেচিত হতে পারে। শসাও ফাইটোইস্ট্রোজেনের উত্তম উত্স।
- আখরোট: এদের মধ্যে আছে ভিটামিন ই, ফোলেট এবং মেলাটোনিনের মতো বেশ কয়েকটি স্নায়ু-রক্ষাকারী যৌগ এবং বেশ কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ উদ্ভিজ উপাদান। মেজাজ রাখায় আখরোটের কার্যকারীতায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস এবং কার্যকরী উপাদানগুলির যথেষ্ট ভুমিকা আছে। আখরোট ছাড়াও মেলাটোনিন হরমোনযুক্ত অন্যান্য বীজ ও বাদামও ঘুমের ব্যাঘাত ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে।
- ডার্ক চকলেট: যাদের দুশ্চিন্তার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি, তারা ডার্ক চকোলেট খেলে উপকার পেতে পারেন। কারণ এটি স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল ও ক্যাটেকোলামাইনের ওপর স্বস্তিদায়ক প্রভাব ফেলে। ফলে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার প্রতিকারে এটিকে মূল অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যদি এটি নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার
হরমোন একটি ক্ষুদ্র বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে এবং সুস্থ মন ও শরীরের জন্য এর সঠিক ভারসাম্য অপরিহার্য। হরমোনগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় বা বয়ঃসন্ধির শুরুর সময়, প্রাক-মেনোপোজ পর্যায়ে, মেনোপজ পর্যায়ে এবং অন্যান্য পরিবেশগত কারণে ওঠানামা করতে পারে যা গুরুতর রোগ ও ব্যাধির কারণ হতে পারে। তবে, পেশাদারী চিকিত্সাগত পরামর্শের পাশাপাশি হরমোন ভারসাম্য সমস্যাগুলির জন্য খাদ্যতালিকায় খাদ্যের সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যকর নির্বাচন একটি পুষ্টিকর জীবনধারা বজায় রাখতে হরমোনের মাত্রা পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করতে পারে।