বাচ্চাকে বড় করে তোলার জন্য আপনাকে ভাল এবং মন্দ উভয় পরিস্থিতিই দক্ষতার সাথে সামলাতে হবে। তাই, যখন আপনি তাকে ভাল করে খাওয়াদাওয়া করতে ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলতে দেখেন, তখন আপনি আনন্দিত হয়ে ওঠেন, কিন্তু যখন আপনার শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আপনার মনে উদ্বেগের সঞ্চার হতে পারে। মনে রাখবেন যে আপনার শিশুটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে এবং এটি প্রতিনিয়ত আপসের সম্মুখীন হবে। উপরন্তু, অসুস্থ শিশুরা খাওয়ার সময় অত্যন্ত বায়নাক্কা শুরু করতে পারে, যার ফলে পুষ্টির অভাব ঘটে এবং সুস্থ হলেও দীর্ঘ সময় লাগে। এই কারণেই আপনাকে জানতে হবে যে তাদের কোন খাবার কীভাবে খাওয়ানো উচিত, যদি আপনার শিশু সর্দিকাশি, জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার মতো সাধারণ রোগে আক্রান্ত হয়।

শিশুর জ্বর হলে মাথায় রাখতে হবে এমন গুরুত্বপূর্ণ টিপস:

শ্বাসনালী, প্রস্রাবের নালী, কান বা নাকের যে কোনও ধরনের সংক্রমণ অথবা সাধারণ সর্দিকাশির কারণে জ্বর হতে পারে। কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, তার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল:

  • জ্বরে আক্রান্ত শিশুকে খাওয়াতে হলে কম পরিমাণে ঘনঘন খাওয়ানোই উত্তম উপায়। শুরুর দিনগুলোতে প্রতি 2 ঘণ্টা অন্তর কম পরিমাণে খাবার খাওয়াতে হবে। এর কয়েকদিন পর থেকে প্রতি 4 ঘণ্টা অন্তর কম পরিমাণে খাবার খাওয়াতে হবে। যদি আপনার শিশুটি বমি করতে থাকে, তাহলে যে পরিমাণ খাবার খাওয়াচ্ছেন, তার সাইজ ছোট কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিন, কিন্তু ঘনঘন খাইয়ে যেতে থাকুন।
  • খাদ্যতালিকায় উচ্চ ক্যালোরি ও প্রোটিন থাকাও গুরুত্বপূর্ণ, এবং প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ অন্তর্ভুক্ত করতে ভুলবেন না। প্রকৃতপক্ষে, প্রথম 2-3 দিন শুধুমাত্র তরল খাবারই খাওয়ানো উচিত (যদি ডায়রিয়া না হয়ে থাকে)। স্যুপ, গ্লুকোজ ওয়াটার, ফ্রেশ ফ্রুট জুস, দুধ দেওয়া যেতে পারে।
  • পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে আধা-শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করতে পারেন। জ্বরের সময় খাওয়ানোর উপযোগী কয়েকটি ভাল খাবার হল পুষ্টিকর সুরুয়া, দুধে মেশানো সিরিয়াল, নরম ফল, খিচুড়ি, সিদ্ধ সবজি এবং ম্যাশড কার্ড রাইস। আপনি আপনার শিশুকে দুধের সাথে পিষে দেওয়া বাদাম (আমন্ড, কাজু ইত্যাদি) এর মিশ্রণও খাওয়াতে পারেন।
  • তার ডায়েটে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন দুধ, ডিম, ডাল যোগ করুন। এ সময় নরম মাংস বা বেকড ফিশও খাওয়াতে পারেন।
  • জিঙ্ক, ভিটামিন C, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট খাওয়ানোর ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে যাবেন না। বরং এইসব নিউট্রিয়েন্টে ভরপুর খাবারগুলি খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
  • ভাজা, চর্বিযুক্ত ও মশলাদার খাবার খাওয়ানো একেবারেই এড়িয়ে চলুন। এ ছাড়া উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবারও এড়িয়ে চলুন। যদিও এগুলো নিয়মিত ডায়েটের অংশ হিসেবে দারুণ সব খাবার, তবে আপনার বাচ্চার জ্বর হলে এগুলো হজম করা কঠিন হতে পারে। এছাড়াও প্রচুর পুডিং, পেস্ট্রি, তীব্র স্বাদের পানীয়, ক্রিম স্যুপ, এবং প্রচুর পরিমাণে ঘি, বাটার ও ভেজিটেবিল অয়েল এড়িয়ে চলুন।
  • যদি আপনার শিশুর সর্দিকাশি হয়, তবে আদা দিয়ে তৈরি গরম স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। এগুলি ডিকনজেস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করতে পারে।
  • শিশু যদি খেতে না চায়, তবে তাকে জোর করে খাওয়াবেন না। কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।

ডায়রিয়া ও বমিজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুকে কী খাওয়াবেন

ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা পরজীবীর সংক্রমণের ফলে ডায়রিয়া হতে পারে। আর চিকিৎসা না করালে ডিহাইড্রেশন ও অন্যান্য মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যার সমাধানের কয়েকটি উপায় নীচে তুলে ধরা হল:

  • ডায়রিয়ার তীব্রতার ওপর খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে। গুরুতর ডায়রিয়া বেশ ভয়ঙ্কর হতে পারে এবং কেন ডায়রিয়া হচ্ছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। যদি আপনার বাচ্চাকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম সক্রিয় মনে হয়, তার মুখ শুকনো এবং আঠালো থাকে, কান্নার সময় চোখ দিয়ে জল বের হয় না, তার ক্রমাগত জ্বর বা পেটে ব্যথা হয়, অথবা 6 ঘন্টার জন্য কোনও প্রস্রাব হয় না, অথবা যদি মলের মধ্যে রক্ত বা শ্লেষ্মা থাকে, তাহলে সতর্ক হন।
  • 3টি প্রধান মিলের পরিবর্তে শিশুকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ঘন ঘন খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
  • প্রোবায়োটিক তার পরিপাক ক্ষমতা বাড়াতে এবং ক্ষতিকর অণুজীবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। দই বা পাতলা বাটারমিল্ক দারুন বিকল্প এবং শিশুদের ডায়রিয়ার জন্য সুপরিচিত ঘরোয়া চিকিৎসা।
  • যদি আপনার ডাক্তার সুপারিশ করেন, তবেই কেবল আপনি প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করতে পারেন।
  • সহজপাচ্য খাবারগুলি সাধারণত ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাল। এর মধ্যে ভাল করে রান্না করা ডিম, অ্যাপেলসস, পাস্তা বা হোয়াইট রাইস, প্যানকেক এবং রিফাইনড ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি, ম্যাশ করা কলা, বেকড পটেটো, বেক বা সেদ্ধ করা চিকেন, মাছ বা টার্কি থাকতে পারে।
  • বাচ্চাকে তার স্বাভাবিক ডায়েট আবার নতুন করে শুরু করার জন্য সময় দিন। অনেক সময় স্বাভাবিক ডায়েটে দ্রুত ফিরে যাওয়ার ফলে অবস্থা আবার শোচনীয় হয়ে যেতে পারে।
  • ভাজা, তেলতেলে, প্রসেস করা বা ফাস্টফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এছাড়া ফ্রুট জুস, ক্যাফেইন এবং কার্বোনেটেড পানীয় খাওয়া থেকেও বিরত থাকুন। ব্রকোলি, গোলমরিচ, বিন, বেরি, ছোলা ইত্যাদি গ্যাসযুক্ত খাবার থেকে দূরে থাকাই ভাল।

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে শিশুকে কী খাওয়াবেন

কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা যা আপনি যখন আপনার শিশুকে সম্পূরক খাদ্য খাওয়ানো শুরু করেন তখন থেকেই বৃদ্ধি পায়। শিশুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে কম ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ, কম হাইড্রেশন এবং অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার কারণে। এই একই পদ্ধতি মেনে চলার উপায়গুলো নীচে তুলে ধরা হল:

  • কোষ্ঠকাঠিন্যের একটি ভালো ঘরোয়া চিকিৎসা হল শিশুর ফাইবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। দ্রবণীয় ফাইবার মলের মধ্যে জল আটকে দেয়, যার দরুন মল বের হওয়া সহজ করে তোলে, অন্যদিকে অদ্রবণীয় ফাইবার মলের সাথে বাল্ক যোগ করে, যার ফলে অন্ত্র পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে অতিরিক্ত ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে পেটে গ্যাস হতে পারে। তাই শিশুর ফাইবার গ্রহণের মাত্রা ক্রমশ বাড়ানোর চেষ্টা করুন। এ ছাড়া, দ্রবণীয় ফাইবার যেহেতু জল শোষণ করে, তাই তারা যাতে বেশি করে জল খায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
  • অনেক সময় শুধু ডায়েটে জল বা জুস যোগ করলেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • আপনার শিশুর ডায়েটে ফাইবার যুক্ত করার ক্ষেত্রে ফলমূল ভাল বিকল্প কিন্তু ড্রাই ফ্রুট আরও ভাল-- এপ্রিকট, ডুমুর এবং প্রুন খেতে দিন।
  • কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগা শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল রেসিপিগুলির মধ্যে একটি হল ওটমিল ব্র্যান - এক কাপ ফল মেশানো ওটমিল যথাযথ খাবার হতে পারে।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ানো বিরত থাকুন কারণ এতে ফাইবার কম এবং ফ্যাট ও নুন বেশি থাকে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত শস্য (যেমন ময়দা ও পলিশড রাইস বা ধুলো ঝাড়া চাল) এড়িয়ে চলুন, কারণ তাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার উপস্থিত থাকে না।

প্রাথমিক পর্যায়েই এই সাধারণ রোগগুলো শনাক্ত করে সহজ ঘরোয়া চিকিৎসার সাহায্যে ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয় এবং আপনার সন্তান তারপরেও একই সমস্যায় ভুগতে থাকে, তাহলে অবিলম্বে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।