আপনি যখন খাওয়ার ব্যাধির কথা ভাবেন তখন আপনি সম্ভবত একজন কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে থাকা এই সমস্যার কথা ভাবেন। বাস্তবে দেখা যায়, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম শিশুদের ওপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হওয়ায় শিশুদের খাদ্যাভ্যাসের বিকারগুলি বৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। যেহেতু বর্তমানে বাচ্চাদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যা দেখা দেয়, তাই সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং লক্ষণগুলি সনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরণের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম এবং সেগুলি পরিচালনা করতে আপনি কী করতে পারেন সে সম্পর্কে সবকিছু বুঝতে এই লেখাটি পড়ুন।

শিশুদের মধ্যে সাধারণ ধরনের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়

যেহেতু শিশুরা বর্তমানে ডায়েট ও বডি শেমিং দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, তাই তাদের প্রভাবিত করতে পারে এমন খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যাগুলির ধরন সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। 12 বছরের কম বয়সী ছোট বাচ্চার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যা দেখা কঠিন কিন্তু হঠাৎ করে ওজন কমানোকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের মূলত তিনটি প্রধান সমস্যা রয়েছে।

  1. অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা- এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে শিশুরা খুব কম খায়, যার ফলে ওজন কম হয়। এর প্রধান কারণ তারা মনে করে যে বন্ধুদের মধ্যে তাদের মোটা দেখায়। অ্যানোরেক্সিয়া আক্রান্ত শিশুরা খুব কঠোর ডায়েট মেনে চলে এবং সব সময় শুধু ক্যালোরি নিয়ে চিন্তা করে।
  2. বুলিমিয়া নার্ভোসা- যদিও এটি শিশুদের মধ্যে বিরল, তবে এটি এমন একটি অবস্থা যা ব্যক্তিকে অত্যধিক পরিমাণে খাবার খেতে বাধ্য করে এবং তারপরে ক্ষয়প্রাপ্ত ক্যালোরি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়গুলি সন্ধান করার প্রয়োজন পড়ে। তারা বেশিরভাগই তাদের খাওয়া সমস্ত কিছু ফেলে দেয়, যাকে 'পার্জিং' বলা হয়। ওজন ধরে রাখার জন্য তারা প্রচণ্ড ব্যায়াম করে অথবা ওজন কমানোর পিল, ল্যাক্সেটিভ ও মূত্রবর্ধক ওষুধ খেয়ে থাকে।
  3. অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া - এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে শিশু বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত খায় এবং ক্ষুধার্ত না থাকলেও সে কী খাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলে মনে হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলেই তারা নিজেকে অপরাধী মনে করতে শুরু করে এবং মন খারাপ হয়ে যায়। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুরা অতিরিক্ত ওজন বা মেদসম্পন্ন হয়ে পড়ে।
  4. পরিহারমূলক/নিষেধমূলক খাদ্য গ্রহণের ব্যাধি (ARFID) - এই অবস্থায় আক্রান্ত শিশুরা শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক খাবার খায়, কারণ খাবারের গঠন, গন্ধ এবং রঙের কারণে তাদের অনীহা সৃষ্টি হয়। তাই তারা ভাল গঠন বিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ওজন অর্জন করে না।

খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের কারণ

খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। পরিবেশ, চাপযুক্ত পরিস্থিতি এবং বংশগত কারণে এটি হতে পারে। তবে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় জড়িয়ে রয়েছে।

  • দেহাকৃতি বা প্রতিচ্ছবি- এটি 10-12 বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে সাধারণ যারা তাদের শরীরের আকৃতি এবং আকার সম্পর্কে খুব সতর্ক।
  • যেসব শিশুর স্থূলতা, মানসিক সমস্যা, বিষণ্নতা এবং অসুস্থতার পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে, তারা প্রায়ই খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের ব্যাধিতে ভোগে। এক্ষেত্রে জিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • যে কিশোর-কিশোরীদের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের ব্যাধি রয়েছে তারা প্রায়শই এমন পরিবারের সদস্য হয় যাদের যোগাযোগের ধরণ খুব খারাপ, উচ্চ মাত্রার চাপ এবং অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে।
  • যে শিশুরা খেলাধুলায় জড়িত তাদের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ তারা পুষ্টির চেয়ে খেলাধুলা এবং পারফরম্যান্সের উপর বেশি জোর দেয়।
  • যেসব কিশোর-কিশোরীর খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যা দেখা দেয়, তারা সাধারণত উদ্বিগ্ন, বিষণ্ন থাকে এবং তাদের মেজাজে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। আবেগের বিকাশের ক্ষেত্রে এই শিশুরা অপরিপক্ব হয় এবং সবার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা দেখায়।

উপসর্গ - উপসর্গগুলি মূলত খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের ব্যাধির ধরণের উপর নির্ভর করে। জেনে নিন বাচ্চার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যা হওয়ার কিছু লক্ষণ।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা-

  • শরীরের ওজন কম, এবং BMI স্বাভাবিকের চেয়ে কম
  • ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়
  • ওজন কম হওয়া সত্ত্বেও মোটা হওয়ার অভিযোগ
  • খিদে পেলেও খেতে না চাওয়া
  • অস্বাভাবিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস
  • অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করা
  • অ্যানোরেক্সিয়ার সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি অন্যান্য লক্ষণ হল ডিহাইড্রেশন, অস্বস্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি এবং ত্বক হলদেটে হয়ে যাওয়া

বুলিমিয়া নার্ভোসা-

  • অতিরিক্ত উপবাস, অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, ফেলে দেওয়ার প্রবণতা, খাবার খাওয়া বন্ধ করতে না পারার ভয়ের অনুভূতি
  • শরীরের কম ওজন
  • অনিয়মিত ঋতুস্রাব
  • উদ্বেগ
  • শরীরের আকৃতি ও আকার নিয়ে অসন্তোষ
  • বিষণ্নতা
  • অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ফোলা মুখ, দাঁতের ক্ষয়, ঘন ঘন পেট খারাপ হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গলা ব্যথা

অত্যাধিক খাওয়া-

  • অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত খাওয়া
  • খিদে না পেলেও বেশি খাওয়া
  • রান্নাঘর থেকে চুপিচুপি খাবার খাওয়া
  • উদ্বেগ

খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের ব্যাধিগুলির চিকিৎসা

এই ধরনের ব্যাধিগুলি এমন একটি টিম দ্বারা সর্বোত্তম উপায়ে চিকিৎসা করা হয় যেখানে একজন ডায়েটিশিয়ান, একজন ডাক্তার এবং একজন পরামর্শদাতা থাকেন। বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যার জন্য ডাক্তার কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন, অন্যদিকে ডায়েটিশিয়ান রোগীকে ওজন বৃদ্ধি এবং হ্রাস সম্পর্কে পুষ্টি-সম্পর্কিত আলোচনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গুরুতর ক্ষেত্রে, মানসিক অসুস্থতার জন্য শিশুকে উন্নত যত্ন এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে।

খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের সমস্যা সমাধানে বাবা-মায়ের ভূমিকা

প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানের আচরণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপরের লক্ষণগুলির মধ্যে কোনও একটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তা দেখা। পাওয়া গেলে তাদের অবশ্যই এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে হবে:

  1. সন্তানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন এবং শান্ত ও যত্নশীল হোন। তাদের সমস্যা সম্পর্কে তাদের সাথে কথা বলুন, তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করান। ধৈর্য ধরে সহযোগিতা করুন।
  2. যদি আপনি উপরের উপসর্গগুলির মধ্যে কোনটি লক্ষ্য করেন, তবে কোনও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাহায্য নিন। শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন।
  3. নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গেলে উপকার পাওয়া যায়। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের অসুখের চিকিৎসায় সময় লাগে, তাই মা-বাবার প্রয়োজনীয় ধৈর্য থাকা উচিত।
  4. বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদের খাদ্যের পুষ্টিগুণ এবং সামগ্রিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য তাদের উপকারিতা সম্পর্কে বোঝানো।