খাবার ও আবেগ প্রায়শই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়, কারণ বিভিন্ন ধরনের খাবার মস্তিষ্কে সুখ, শান্তি এবং এমনকি নিস্তেজতার অনুভূতি জাগাতে পারে। আমরা তখনই আবেগের বশে খাবার খাই যখন খাবার আমাদের আবেগিক ইঙ্গিতের প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হয়। যেমন, যখন কেউ উত্তেজিত ও খুশি হন, তখন তাদের মধ্যে মিষ্টি ও স্ন্যাক্সস জাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং একাকীত্বের কারণে কিশোর-কিশোরীরা বিঞ্জ ইটিং (একনাগাড়ে খেতে থাকা) বা অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার (ওজন ও খাওয়াদাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করা) মতো খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই আবেগের বশে খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা একাধিক বিপাকীয় সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই আপনার সচেতন হওয়ার উপযোগী কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে এখানে জানানো হল।

আবেগের বশে খাবার খাওয়ার দরুন শিশুর উপর পড়া প্রভাব

শৈশব এমন একটি পর্যায় যে সময়ে আপনার সন্তান একাধিক পরিবর্তন অন্বেষণ করে, শেখে এবং অনুভব করে, যেগুলি মাঝেমধ্যে উদ্বেগ, স্নায়ুচাপ, একাকীত্ব, বিষণ্ণতা বা একঘেয়েমির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এর ফলে প্রায়শই তারা আবেগের বশে খাবার খেতে থাকে, যেখানে তারা নোনতা এবং চিপস, পিৎজা, কুকিজ ইত্যাদির মতো মুচমুচে খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা প্রকাশ করে। এই অধিক-ফ্যাটযুক্ত এবং প্রসেস করা খাবারগুলি শরীরে এক ধরনের রাসায়নিককে সক্রিয় করে তোলে, যা তৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার অনুভূতি দেয় এবং আসক্তি সৃষ্টি করে। এর ফলে অস্বাস্থ্যকরভাবে ওজন বাড়তে পারে এবং শিশুদের মেদবৃদ্ধি হতে পারে। এভাবে আবেগের বশে খাওয়া তাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং যদি এই অভ্যাসগুলি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বজায় থাকে, তবে প্রভাব আরও বেশি করে পড়ে। অন্যান্য জটিলতার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার রোগ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যা।

আবেগের বশে খাওয়ার সুবিধা-অসুবিধা

আবেগের বশে খাওয়ার সাথে যুক্ত সুবিধা-অসুবিধাগুলি হল-

সুবিধা অসুবিধা
আপনার সন্তান কম চাপ অনুভব করবে এবং অপরাধবোধে ভুগবে না আবেগের বশে খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও বিপাকীয় রোগ হতে পারে
সে খাবার উপভোগ করতে এবং আরাম করতে পারবে আপনার সন্তানের মানসিকতা পরিবর্তন করা সমস্যাজনক হতে পারে
এতে তার আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে খাবারের প্রতি পছন্দ-অপছন্দ বিভ্রান্তিকর হতে পারে, যার দরুন পুষ্টি অনুপযুক্ত হয়

আবেগের বশে খাওয়ার প্রবণতা কাটিয়ে ওঠার টিপস

  1. স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিন- বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, টিভি দেখা ও অতিরিক্ত খাওয়ার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ শিশুই খিদে নির্বিশেষে টিভি দেখার সময় স্ন্যাক্স খেতে পছন্দ করে। তাদের বেশিরভাগই টিভিতে দেখানো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, কেন না এগুলিতে চিনিযুক্ত এবং ফাস্ট ফুডের প্রচার করা হয়। তাই, সারা দিনে 2 ঘন্টার বেশি টেলিভিশন বা মোবাইল দেখার পরামর্শ দেওয়া হয় না।
  2. খাবার রাখার নির্দিষ্ট স্থান- রান্নাঘর বা ডাইনিং এরিয়ায় খাবার রাখা উচিত, যাতে শিশুরা নির্দিষ্ট খাওয়ার জায়গা সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এইভাবে, তারা টেলিভিশন থেকে হওয়া কম চাক্ষুষ উদ্দীপনার সম্মুখীন হবে। তাদেরকে আপনার ফল ও শাক-সবজির স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক্সের বিকল্পও খেতে দেওয়া উচিত।
  3. আবেগের বশে ইতিবাচক খাওয়ার বিষয়ে সচেতন থাকুন- প্রায়শই সন্তান ক্লাসে সর্বোচ্চ গ্রেড পেলে মা-বাবারা তাদের হট ফাজ সানডি বা ফাস্ট ফুড খাইয়ে থাকেন। যদিও মাঝেমধ্যে ট্রিট দিলে অসুবিধে নেই, তবে এইভাবে সন্তানদের পুরস্কৃত করার বিষয়ে আপনার সচেতন হওয়া উচিত। এর পরিবর্তে আপনি পরিবার সমেত বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন এবং কিছু ঐতিহাসিক বা শিক্ষামূলক স্থান পরিদর্শন করতে পারেন।
  4. ডায়েটিং বা খাবার না খাওয়ার অভ্যাস প্রতিরোধ করুন - কয়েকজন মা-বাবা সন্তানদের খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর নিয়মকানুন জারি করতে পারেন, যার দরুন খাবার খাওয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। মনে রাখবেন যে বাচ্চাদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ন্যায্য পরিমাণে ক্যালোরি প্রয়োজন, তাই তাদের খাবার সুষম হওয়া উচিত। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বাবামায়ের রোল মডেলের ভূমিকা পালন এবং শিশুদের মধ্যে ডায়েটিং বা খাবার না খাওয়ার অভ্যাস নিরুৎসাহিত করা উচিত।
  5. রোজকার খাবার-দাবারের রেকর্ড রাখুন- আপনার সন্তানের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে কী খায় তা ট্র্যাক করার জন্য একটি ফুড জার্নালে লেখালেখি শুরু করুন। আবেগের বশে খাওয়ার অভ্যাস দূর করতে, কিশোর-কিশোরীদের এই কাজটি নিজে থেকে করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা উচিত।
  6. পরিবেশভিত্তিক অবদান সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করুন- বাচ্চাদের লাঞ্চ যেন সর্বদা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও সেইসাথে তাদের স্বাদের সঙ্গে মানানসই হয়। মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর খাবার খেতে দিলে তারা ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকসের দিকে ঝুঁকতে পারে এবং বন্ধুদের চাপও এর আরেকটি কারণ হতে পারে।
  7. পরিকল্পনা করে ঘুরতে যান- ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক এবং তারা তাদের এনার্জিকে বিভিন্ন উপায়ে চালিত করতে চায়। তাই সবসময়েই ভাল হয় যদি মা-বাবারা সন্তানের সাথে একসাথে পরিকল্পনা করে হাইক করতে যান, স্থানীয় পার্কে ঘুরতে যান বা চিরাচরিত ফুটবল গেম খেলেন বা ডগিকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। এটি আপনার বাচ্চাদের সদা-চঞ্চল এবং কম একাকী রাখবে এবং আবেগের বশে বেশি করে খাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেবে।
  8. আপনার কথাবার্তাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করুন- আপনার সন্তানদের সমালোচনা করা বা তাদের ডায়েট সম্পর্কে কঠোরভাবে কথা বলার পরিবর্তে তার চাহিদা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়শই মা-বাবারা তাদের সন্তানকে অতিরিক্ত ওজনের জন্য বিব্রত বোধ করান এবং তাদের অজান্তে সুস্থ জীবন যাপন করা থেকে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। সুতরাং, বিবেচনা করা শব্দগুলি ব্যবহার করুন, তাদের সমস্যাগুলি শুনুন এবং তাদের স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ও শারীরিকভাবে সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করুন।

উপসংহার

আবেগের বশে খাওয়ার বিষয়টি উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে। আপনার সন্তানের খিদে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকারের চাহিদার উপর নির্ভর করে। যদিও শারীরিক বা সত্যিকারের খিদে পেলে অনেকগুলি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে পেট ভরানো সম্ভব, যেগুলি পূর্ণতার অনুভূতি দেয়, অন্যদিকে আবেগের বশে খিদে নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্খাকে চাগিয়ে তোলে, যা প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর হয়। শিশুরা একাকী, উদ্বিগ্ন, হতাশাগ্রস্ত বা অপরাধ বোধ করলে সাধারণত বেশি করে খাবার খাওয়া বা ফ্রায়েড ও ফ্যাটযুক্ত খাবারের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। সুতরাং, তারা কী খায় তা নজরে রাখা এবং সর্বদা মানসিক সাহচর্য দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।