শৈশবে খাদ্যের এলার্জি হয় যখন আপনার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণ পদার্থেদের ক্ষতিকারক বা এলার্জিকারক হিসাবে বিবেচনা করে। অন্য কথায়, আপনার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলভাবে একটি নির্বিষ পদার্থকে বহিরাগত হিসাবে চিহ্নিত করে এবং হিস্টামিনের মতো সুরক্ষামূলক রাসায়নিকগুলি ছেড়ে দিয়ে এটিকে নির্মূল করার চেষ্টা করে, যার ফলে চরম উপসর্গ বা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। খাদ্য এলার্জি সাধারণত অনেক ভারতীয় শিশুদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে যখন এটি গাছের বাদাম, ডিম, গরুর দুধ, গম, শেলফিশ এবং সোয়া জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে আসে। তাই, আরও বেশি করে জানতে এবং সতর্ক থাকতে, এখানে পড়ুন।
উপসর্গ সহ খাদ্য অ্যালার্জির প্রকার
- দুধের অ্যালার্জি - এটি যাবতীয় খাদ্য এলার্জিগুলির মধ্যে অন্যতম যেখানে শিশুদের গরুর দুধে অ্যালার্জি হয়। গরুর দুধ খাওয়ার মাধ্যমে এলার্জি শুরু হয় এবং এর ফলে পেটে ব্যাথা, পেট ফুলে যাওয়া, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
- চিনাবাদামের অ্যালার্জি -এই অ্যালার্জিতে অ্যালার্জেনকে রান্না বা গরম করে নষ্ট করা যায়না বলে এই অ্যালার্জি জীবনঘাতী হতে পারে। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে নাক দিয়ে জল পড়া, ত্বকের প্রতিক্রিয়া, মুখ বা গলার চারপাশে লাল এবং ফুলে যাওয়া এবং শ্বাসকষ্ট।
- ডিমের অ্যালার্জি- এটি ওভোমুকয়েড,ওভালবুমিন এবং কোনাল্বুমিন নামক ডিমের প্রোটিনগুলির দ্বারা সক্রিয় হয় এবং কখনও কখনও এর কারণে অ্যানাফাইল্যাক্সিসও হতে পারে। রান্না করলে কিছু এলার্জি সৃষ্টিকারী উপাদানকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু কিছু শিশু রান্না করা ডিমের প্রতিও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে লাল দাগ বা র্যাশ, ডায়রিয়া, বমি ভাব ইত্যাদি।
- মাছে এলার্জি: মাছের প্রোটিন অ্যানাফাইলেক্সিস এর মত মারাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলির সৃষ্টি করতে পারে। ত্বকে জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ কমে যাওয়া, বমি ভাব ও ডায়রিয়া এই রোগের সাধারণ লক্ষণ।
- গমের এলার্জি- এটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, এই এলার্জি সাধারণত 3 বছর বয়সে সর্বোচ্চ হয়, এবং কখনও কখনও এটিকে সেলিয়াক রোগ হিসাবে ভুল হয়। সেলিয়াক ডিজিজ একটি পরিপাকজনিত ব্যাধি, যার মধ্যে গ্লুটেনের প্রতিক্রিয়া জড়িত। এই অ্যালার্জির লক্ষণগুলির মধ্যে আছে জলীয় ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, পেটে ব্যথা ইত্যাদি।
- সয়াবিনের অ্যালার্জি - এটি সাধারণ খাদ্য অ্যালার্জিগুলির মধ্যে একটি, এবং কখনও কখনও 2 বছর বয়সে এটি চলে যেতে পারে। উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
নিম্নে কিছু সাধারণ শৈশবের খাদ্য এলার্জির মিথ গুলি সম্বন্ধে বলা হল:-
মিথ 1: খাদ্য এলার্জি কোনও গুরুতর বিষয় নয় এবং এটি আজীবনের জন্য।
সত্য ঘটনা: ফুড অ্যালার্জি একটি মারাত্মক গুরুতর সমস্যা। এর ফলে বমি ভাব, পেট ব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরার মতো একাধিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যদি অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ায় শরীরের বিভিন্ন অংশ জড়িত থাকে, তাহলে এর ফলে অ্যানাফিল্যাক্সিস হতে পারে, এবং এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। তাই বাবা-মায়েদের উচিত তাদের সন্তান কী খাচ্ছে এবং খাদ্যে কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তা নিয়ে সতর্ক থাকা। অ্যালার্জি সারাজীবন নাও থাকতে পারে, কারণ শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া অদৃশ্য হয়ে যায়।
মিথ 2: ত্বক এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ফুড অ্যালার্জি শনাক্ত করা যায়।
সত্য ঘটনা: এটি সব ক্ষেত্রে সত্য নয়,যেহেতু কিছু শিশুর একটি নির্দিষ্ট খাদ্য এলার্জিকারকের জন্য পরিমাপযোগ্য IgE অ্যান্টিবডি থাকে, কিন্তু কোন উপসর্গ দেখা যায় না। পজিটিভ স্কিন প্রিক ও ব্লাড টেস্ট সব সময় সঠিক হয় না। প্রায় 50 থেকে 60% শিশুদের ভুলভাবে পজিটিভ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যার অর্থ তাদের পরীক্ষা ইতিবাচক হয়, এমনকি যদি তারা সেই খাবারের প্রতি অ্যালার্জি নাও থাকে। এ ক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে খাবার চ্যালেঞ্জ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মিথ 3: বিগ 8-কে ব্যান করাই যথেষ্ট।
সত্য ঘটনা: খাদ্যের এলার্জি মারাত্মক হতে পারে এবং শুধুমাত্র সাধারণ খাদ্যের এলার্জি যেমন দুধ, ডিম, চিনাবাদাম, গাছ বাদাম, গম, সয়া, মাছ এবং শেলফিশে সেটি সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। কারণ এই সমস্ত খাবারগুলি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং এগুলি আপনার শিশুর সামগ্রিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। আপনার শিশুর খাদ্যতালিকা স্থির করার আগে তার সঠিক এলার্জি নির্ণয় করা উচিত।
মিথ 4: খাবারের ছোট টুকরা খেলে এটা হবেনা।
সত্য ঘটনা: এমনকি সামান্য একটু অ্যালার্জিজনিত খাবার খেলেই মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। আপনার শিশুকে নিরাপদ রাখার জন্য তার খাদ্য থেকে সম্ভাব্য খাদ্য এলার্জি অপসারণ করা আবশ্যক। খাদ্য এলার্জিকারক এবং নিরাপদ খাদ্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন, যাতে আকস্মিকভাবে এলার্জি এক খাদ্য থেকে অন্য খাদ্যে স্থানান্তরিত না হয়।
মিথ 5: প্রতিটি অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হয়।
সত্য ঘটনা: খাদ্য এলার্জি প্রতিক্রিয়া হালকা এবং মাঝারি থেকে গুরুতর হতে পারে, আর এটি নির্ভর করে আপনার শিশুর শরীর কিভাবে নির্দিষ্ট এলার্জি প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর এটা সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হয়, এমন নয়। তবে আপনাকে সব সময় আপতকালীন ওষুধ প্রস্তুত রাখতে হবে।
মিথ 6: খাদ্য অ্যালার্জি ও খাদ্য অসহিস্নুতা একই।
সত্য ঘটনা: খাদ্য এলার্জি IgE মধ্যস্থতায় হয়, কিন্তু খাদ্য অসহিষ্ণুতায় সেই কারণে হয়না, এর অর্থ, আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইমিউনোগ্লোবুলিন ই (IgE) উত্পন্ন করে, যা এমন একটি অ্যান্টিবডি যা অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী হিস্টামিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক নিঃসরণের মাধ্যমে যে কোনও খাদ্য অ্যালার্জিকারককে সনাক্ত করে এবং লড়াই করে। অন্যদিকে, খাদ্য অসহিষ্ণুতার সাথে কোনও ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জড়িত নয়। এতে কেবলমাত্র অস্বস্তি হয়, কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি থাকে না।
উপসংহার
ফুড অ্যালার্জিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে কারণ 90% অ্যালার্জি হয় প্রোটিনযুক্ত খাবারের কারণে। আপনার সন্তান যদি কোনো খাদ্যদ্রব্যের প্রতি এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে তাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করানো উচিত। একটি শিশুর কাছে এক এক করে নতুন খাদ্যদ্রব্য (ছয় মাস বয়সের পরে) নিয়ে আসুন, এবং দেখুন যে কোনও খাদ্যে সে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়ার দেখাচ্ছে নাকি।