প্রোটিন আপনার সন্তানের বৃদ্ধি, বিকাশ ও সামগ্রিক সুস্থতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নিউট্রিয়েন্টটি ছাড়া, হাড়, পেশী, তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ, এমনকি ত্বকও সঠিকভাবে বিকাশিত হতে পারে না। তাছাড়া অনেক হরমোন ও এনজাইমও গঠনগত দিক থেকে প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, যদি আপনার সন্তানের খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিনের অভাব থাকে, তাহলে তার পেশী নাও গঠিত হতে পারে, ফ্র্যাকচারের প্রবণতা বেশি হতে পারে এবং ত্বক, নখ ও চুল সম্পর্কিত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। যে সব বাচ্চারা নিরামিষ খাবার খায় তাদের মধ্যে প্রোটিনের ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ তারা ডিম, মাংস, মাছ এবং হাঁস-মুরগির মতো প্রোটিনের শক্তিশালী প্রাণিজ উৎসগুলি ভক্ষণ করে না। যদিও, আপনি যে ডায়েটই অনুসরণ করুন না কেন, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার বাচ্চাদের পরিবেশন করা সবসময় সম্ভব। প্রয়োজন সামান্য সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও পরিকল্পনা।

আপনার সন্তানের খাদ্যে প্রোটিন অপর্যাপ্ত থাকলে তা কীরকম প্রভাব ফেলে?

পেশী তৈরি এবং টিস্যু সুগঠিত হওয়ার জন্য শিশুদের প্রতিদিন প্রস্তাবিত পরিমাণে প্রোটিন খাওয়ানো প্রয়োজন। যারা খেলাধুলা বা অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করে, তাদের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রোটিন দেহে ভিটামিন ও মিনারেল পরিবহনেও সাহায্য করে। শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ না করলে, সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

আপনার সন্তানের কতটা পরিমাণ প্রোটিন প্রয়োজন?

WHO অনুসারে, ভারতীয় শিশুদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের প্রস্তাবিত খাদ্যগত পরিমাণ (প্রতি দিন প্রতি কেজিতে গ্রাম) হল:

  • জন্ম থেকে 3 মাস অব্দি - 2.40 গ্রাম।
  • 3 থেকে 6 মাস অব্দি - 1.85 গ্রাম। .
  • 6 থেকে 9 মাস অব্দি - 1.62 গ্রাম। .
  • 9 থেকে 11 মাস অব্দি - 1.44 গ্রাম। .
  • 1 থেকে 3 বছর বয়সী শিশু - প্রায় 1.2 গ্রাম। .
  • 4 থেকে 6 বছর বয়সী শিশু - প্রায় 1 গ্রাম। .
  • 7 থেকে 9 বছর বয়সী শিশু - প্রায় 0.9 গ্রাম। .

সহজ ভাষায়, একটি ডিমে প্রায় 7 গ্রাম প্রোটিন এবং এক কাপ (244 গ্রাম) দুধে 8 গ্রাম প্রোটিন থাকে। সুতরাং, আপনি দিনে 5 বার খাওয়ার জন্য নির্ধারণ করে প্রোটিনের দৈনিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারেন। ব্যাপারটা খুবই সহজ। আপনার সন্তান যদি প্রোটিন খাদ্যের উৎস সম্পর্কে বায়নাক্কা করে, তাহলে এখানে কিছু টিপস রয়েছে যা সাহায্য করতে পারে।

আপনার শিশুর খাদ্যতালিকায় আরও প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করার টিপস

1. দুধ খাওয়ানো নিয়ে সৃজনশীল হন

সব মায়েরা দুধের গুরুত্ব বোঝেন। এটি শিশুদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে কয়েকটি শিশু নানা কারণে এটি খেতে পছন্দ করে না। সরাসরি পরিবেশন না করে দুধ দিয়ে স্মুদি বানিয়ে ব্রেকফাস্টে পরিবেশন করুন। একটি স্মুদিতে দুধ, নাট বাটার, দই বা চিয়া বীজ যোগ করা তার ডায়েটে কিছু অতিরিক্ত প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করার একটি চতুর উপায়। মিষ্টি স্বাদে তাকে মুগ্ধ করার জন্য কিছু টাটকা ফল বা ম্যাপেল সিরাপ যোগ করতে পারেন। ফ্যাটানো ডিমে হোল হুইট ব্রেড ডুবিয়ে ফ্রেঞ্চ টোস্টও বানাতে পারেন। আপনার বাচ্চার যদি ল্যাকটোজে অ্যালার্জি থাকে, তাহলে সে সয়া দুধ খেতে পারে।

2. ডিম দিয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করুন

ডিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনের পাশাপাশি অ্যামাইনো অ্যাসিডও রয়েছে। এগুলো ব্রেকফাস্টে বা মিলে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নিয়মিত সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে সে যদি বিরক্ত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মশলা ফ্রায়েড বা পোচড এগ খেতে দিতে পারেন। এগুলি খেতে সুস্বাদু এবং টোস্টড ব্রেড বা রুটির সঙ্গে পরিবেশন করা যেতে পারে।

3. চিকেনের মতো হজমের পক্ষে অনুকূল মাংস খেতে দিন

চিকেন চর্বিহীন মাংসের একটি আদর্শ উৎস এবং ভারতীয় খাদ্যতালিকায় প্রচলিত খাবার। চিকেন দিয়ে বিভিন্ন আইটেম বানাতে পারেন, যেমন- স্যুপ, স্টু, কারি।

4. টক দই যোগ করবেন, যা পেটের স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল ব্যাকটেরিয়ায় সমৃদ্ধ

দই একটি প্রোবায়োটিক খাবার, যাতে রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল ব্যাকটেরিয়া, যা হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া এটি প্রোটিনের ভাল উৎস। টক দই দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করেও খাওয়াতে পারেন। যেমন, এক কাপ দইয়ের সাথে কিছু ফল যোগ করুন এবং কিছু সুস্বাদু খাদ্যশস্য উপর থেকে ছড়িয়ে দিন। দই থেকে প্রস্তাবিত পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়, ফলে আপনার বাচ্চা এইভাবে তার কার্বোহাইড্রেট মিস করবে না।

5. প্রোটিনের উৎস দিয়ে নানা রকমের আকৃতি বানান

মজার মজার আকৃতি ও রঙের প্রতি শিশুরা খুব সহজেই আকৃষ্ট হয়। বাজে দেখতে ও একই ধরনের খাবার খেতে থাকলে তারা একঘেয়েমিতে ভোগে। মাংস ও চিজ প্রোটিনের ভাল উৎস। তাই মিট স্লাইস, চিজ কিউব, ফল দিয়ে স্কেয়ার তৈরি করুন। তারা খুব দ্রুত এগুলো খেয়ে ফেলবে। কুকি কাটারও ব্যবহার করে বিভিন্ন শেপ বানিয়ে দেখতে পারেন।

6. ডায়েটে মাছ যোগ করুন

তাকে তার মাছ খেতে দিন, কারণ মাছ প্রোটিনের একটি আদর্শ উৎস। এমন মাছের জাত বেছে নিন, যার কাটা খুব বেশি নেই, যাতে গলায় আটকে না যায়। প্রোটিনের পাশাপাশি ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস হল রাওয়া, আহি এবং বাগদা। ফিশ ফিঙ্গার বা চপ তৈরি করে জলখাবার হিসেবে পরিবেশন করতে পারেন।

7. বাচ্চাদের ডায়েটে পিনাট বাটার রাখুন

তার ডায়েটে কিছুটা পিনাট বাটার যোগ করুন। পিনাট বাটার শিশুদের কাছে সর্বকালের প্রিয় এবং প্রোটিনের একটি ভাল উৎস। হোল গ্রেন ব্রেড বা ক্র্যাকারে ছড়িয়ে ব্রেকফাস্টে পরিবেশন করতে পারেন। কিছু বৈচিত্র যোগ করতে আপনি সূর্যমুখী বীজ, আমন্ড এবং কাজু বাটারের মতো অন্যান্য ধরণের নাট বাটারও চেষ্টা করতে পারেন। শুধু খেয়াল রাখবেন আপনার বাচ্চার যেন চিনাবাদামে অ্যালার্জি না থাকে।

8. কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বাড়ান

আপনার সন্তান যদি বেশিরভাগ সময় কার্বোহাইড্রেট খেতে পছন্দ করে, তাহলে চিন্তা করার কিছু নেই। আপনি তার কার্বোহাইড্রেট গ্রহণে বৈচিত্র্য যোগ করতে পারেন এবং আপনার সন্তানের ডায়েটে কিছু উচ্চমানের প্রোটিনও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এখানে রইল কিছু আকর্ষণীয় বিকল্প।

  • গ্রিন মুগ স্প্রাউট ধোকলা: এটি একটি প্রিয় গুজরাটি ব্রেকফাস্ট ডিশ যা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও পছন্দ করা হয়। এটি অঙ্কুরিত মুগ ডাল, পালক শাক (স্পিনাচ) আর বেসন দিয়ে তৈরি করা হয়।
  • পোরিজ: স্বাদ এবং পুষ্টির মান উন্নত করতে আপনি কিছু শাকসবজি সহ ভারতীয় খাদ্যশস্য (যেমন জোয়ার) দিয়ে পোরিজ তৈরি করতে পারেন।
  • পোহা: এটি চাল বা পোহা, পেঁয়াজ, সবজি দিয়ে তৈরি করা যায়।
  • পনির পরোটা:পনিরের পুর ভরে পরোটা বানাতে পারেন, যা প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস এবং ব্রেকফাস্টে পরিবেশন করতে পারেন।
  • সাম্বারের সঙ্গে ইডলি: চাল ও কার্ড বাটার দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত ডাল দিয়ে তৈরি সাম্বারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
  • সয়া উপমা: এটি সুজি (সেমোলিনা) অথবা সয়া গ্র্যানিউল দিয়ে তৈরি। বাচ্চার পছন্দের ওপর ভিত্তি করে এর সঙ্গে দিতে পারেন অরহর ডাল, গাজর, পেঁয়াজ ও ফ্রেঞ্চ বিন্স।
  • পালং শাক দিয়ে তৈরি রুটি: বিশেষ করে যেসব শিশু সবুজ শাকসব্জি বা পালং শাক এড়িয়ে চলে তাদের জন্য এটি অতিরিক্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। তার প্রতিদিনের রুটিতে পালং শাক যোগ করে ব্রেকফাস্ট বা মিলের সময় পরিবেশন করুন।

9. তাকে প্রোটিনযুক্ত হালকা খাবার খেতে দিন

যদি আপনার বাচ্চা খাবার খাওয়ার সময় তার প্রোটিন মিস করে থাকে, তাহলে আপনি সবসময় স্ন্যাকস খাওয়ার সময় কিছু না কিছু প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়াতে পারেন। বেকড চিকেন, দই, স্ট্রিং চিজ বা ফ্রেশ ভেজিটেবলের টুকরো সমেত এটা ট্রাই করতে পারেন। ফিশ ফিঙ্গারও ভাল বিকল্প।

10. প্রচুর পরিমাণে নাটস অ্যান্ড সিডস খান

নাটস অ্যান্ড সিডস প্রোটিনের আরেকটি সমৃদ্ধ উৎস এবং এর মধ্যে কয়েকটি আবার ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। আপনি এগুলিকে কুইক স্ন্যাকস হিসাবে বা এমন কিছু হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন, যা খুব চটজলদি খেয়ে ফেলা যায়। আপনার সন্তানকে প্রতিদিন সুপারিশ করা পরিমাণ অনুসারে প্রোটিন খাওয়ানো বেশ সহজ। অনেক শিশু ডিম, দুধ, চিজ ইত্যাদি প্রোটিনের সাধারণ খাদ্য উৎস পছন্দ করে। তবে যদি আপনার সন্তান খাওয়ার সময় বায়নাক্কা করে, তাহলে বেশি ঝামেলা ছাড়াই প্রোটিনের নিয়মিত ডোজ যোগ করতে উপরের টিপসগুলি ব্যবহার করুন।

আপনার সন্তানের বৃদ্ধি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও জানতে www.nangrow.in -এ ভিজিট করুন